সংসদে রাষ্ট্রপতি
দেশে গণতান্ত্রিক শক্তি আরো সুদৃঢ় হয়েছে
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ৮:৪১:৪৯
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, দেশের গণতন্ত্রের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন অত্যন্ত যুগান্তকারী ঘটনা, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় হয়েছে দেশের জনগণের, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের।
মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে দেয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি এই প্রথম জাতীয় সংসদে ভাষণ দিলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদেরসহ সরকার ও বিরোধী দলীয় সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল সহিংসতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের শান্ত-স্নিগ্ধ যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের গণতন্ত্র বিরোধী ও সহিংস কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে জনগণকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখলেও গণতন্ত্রের শাণিত চেতনা ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সকল পদক্ষেপ স্বার্থক হয়েছে। নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে।
গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমাদের আরো উন্নতি করতে হবে। ভবিষ্যতে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। ষড়যন্ত্র করে কেউ যাতে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, সেদিকে সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে, কেউ যাতে আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে মানুষের জানমাল ও জীবিকার ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সকল গুজব ও অপপ্রচারের বিষয়ে নজরদারি বাড়িয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত রেখে যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে হবে। আর্থিক খাতের সংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ও কঠোর পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
ভাষণে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূলভিত্তি। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মহান এ প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সকল প্রত্যাশার ধারক ও বাহক। জনগণের চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকদের কল্যাণে জাতীয় সংসদ যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা। তিনি আরো বলেন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্খার সফল বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো মতদ্বৈততা জনগণ প্রত্যাশা করে না। তাই সংসদকে আরো কার্যকর ও গতিশীল করতে সকলের প্রতি আমি আন্তরিক আহ্বান জানাচ্ছি। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, সশস্ত্রবাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী ও গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ জানিয়ে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, নির্বাচন কমিশন সফলভাবে নির্বাচন পরিচালনা করায় দেশে গণতান্ত্রিক শক্তি আরও সুদৃঢ় হয়েছে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই, জনগণের রায় মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের গণতন্ত্রের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন অত্যন্ত যুগান্তকারী ঘটনা, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় হয়েছে দেশের জনগণের, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে এর প্রভাব আমাদের উপরও পড়বে। এজন্য আমাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কৃষি খাতের উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে, উচ্চ-মূল্য ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দিয়ে রপ্তানি নিশ্চিত করার জন্য উন্নত কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের পণ্যসমূহ রপ্তানি বাজারে যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় সে লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ও কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে গভীর সমুদ্রে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজারের অনুসন্ধান করতে হবে যাতে দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি সম্ভব হয়।
রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি আশা করেন ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণ ও গণতন্ত্রের কল্যাণে অহিংস পন্থায় গঠনমূলক কর্মসূচি পালন করবে। সরকারও এক্ষেত্রে সংযত আচরণ করবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
দীর্ঘ ভাষণে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, করোনা অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও গত প্রায় দেড় দশক যাবৎ জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ছয় দশমিক সাত শতাংশের বেশি। এসময়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলার এবং জাতীয় বাজেটের আকার নয় গুণের অধিক বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়, বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে গত দেড় দশকে আর্থসামাজিক খাতসহ সকল খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এর জন্য সমগ্র দেশবাসীর পক্ষ হতে আমি প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ অর্জন সম্ভব হয়েছে মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, উন্নয়নের মূল ভিত্তি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের অব্যাহত চর্চা। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। গত দেড় দশকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকার কারণে দেশের এ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। উন্নয়ন স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত, তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে। উন্নয়নের এ গতিধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতীয় সংসদ আমাদের গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূলভিত্তি। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মহান এ প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সকল প্রত্যাশার ধারক ও বাহক। তাদের চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকদের কল্যাণে জাতীয় সংসদ যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, জনগণ অনেক আশা নিয়ে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে যাতে তাদের চাওয়া-পাওয়া আপনারা সংসদে তুলে ধরেন। এটাই সংসদ-সদস্য হিসেবে আপনাদের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্রপতি বলেন, সমাজের সকল নাগরিকের আশা-আকাঙ্খা, বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল ও সংগঠনের চাওয়া-পাওয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমন্বয়সাধন করতে হয় জাতীয় সংসদকে। সংসদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ- আইন প্রণয়ন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিসমূহে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য আমি সংসদ-সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
বিরোধী দলের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্খার সফল বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ, মত-পথের ভিন্নতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো মতদ্বৈততা জনগণ প্রত্যাশা করে না। তাই সংসদকে আরো কার্যকর ও গতিশীল করতে সকলের প্রতি আমি আন্তরিক আহ্বান জানাচ্ছি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, করোনা অতিমারির ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা দেশসমূহ এবং রাশিয়ার মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিভিন্ন অবরোধ আরোপের ফলে খাদ্য, জ্বালানিসহ বিশ্বব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আমাদের দেশেও জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে যার প্রভাব জনজীবনে পড়েছে। সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে জনজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিতকরণের চেষ্টা করেছে।