ই-কমার্সে ক্রয়-বিক্রয়ের নিরাপত্তা চাই
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ অক্টোবর ২০২১, ১০:২৭:২৯
১৯৪৮-৪৯ সালের দিকে বার্লিন ব্লোকেইড এবং এয়ারলিফটের দ্বারা টেলেক্সের মাধ্যমে মূলত পণ্য বেচাকেনার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল সেটাকেই বর্তমান ই-কমার্সের পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট প্রচলিত হওয়ার পর এই ব্যবসা ধীরে ধীরে ইন্টারনেটভিত্তিক হয়ে যায় এবং বেশ জনপ্রিয় হতে থাকে। ই-কমার্স শব্দ বা প্রক্রিয়ার নাম আমি প্রথম শুনি পড়াশুনা করতে বিলেতে যাওয়ার পরে, ২০০২ সালে। সে-সময় জীবনে প্রথম ই-কমার্সের মাধ্যমে কেনা একটা হাতঘড়ি উপহার পাই, সেটা আসে জার্মানি থেকে। সেই ই-কমার্স কোম্পানির নাম ছিল ই-বে। ২০০৫ সালের দিকে অনলাইনে বাংলাদেশি পত্র-পত্রিকা পড়ে দেশেও ই-কমার্সের যাত্রা শুরুর খবর পাই। সুদূর বিলেত থেকে আমি আমার বাবাকে ফুল পাঠাই এবং শুভেচ্ছা জানাই। কিন্তু কিছুদিন পরই পত্রপত্রিকায় দেখতে শুরু করি যে, এই ই-কমার্সের মাধ্যমে বিক্রেতা ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। বাসায় পণ্য পৌঁছে দেওয়ার নাম করে ডাকাতির ঘটনাও ঘটছে। আবার কেউবা সঠিক পণ্য না দিয়ে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করছে। ফলে সেই সময় একটা সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটেছিল। সুযোগ ছিল, কিন্তু সেটা আসলে মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারেনি তখন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ২০০৪ সালে দিকে ফেইসবুকের যাত্রা শুরু হলেও বাংলাদেশে ২০০৮ সালের শেষদিকে ফেইসবুকের ব্যবহার শুরু হয়। পাশাপাশি নানা রকমের সোশ্যাল মিডিয়াও আসতে থাকে। এসময় ই-কমার্স আবার পথচলা শুরু করে। কিছু তরুণ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এই প্লাটফর্ম নিয়ে। ঢাকার ব্যস্ত জীবনে অনেকেই বই থেকে শুরু করে খাবার, পোশাক, যানবাহন সেবাসহ অনেক কিছুই ই-কমার্সের দ্বারা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বিশেষ করে যারা অনেক ব্যস্ত এবং মোটামুটিভাবে সচ্ছল। দিন দিন তারা এই ই-কমার্সের ওপরে ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। করোনার কারণে এই মাধ্যম অনেক গ্রাহকের আস্থা অর্জন করেছে। তবে কিছু কিছু কোম্পানির সেবা নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি ছিল। ছিল অতৃপ্তি, যা এখনো আছে। সম্প্রতি ই-ভ্যালি নামের এক ই-কমার্স কোম্পানি সেই অসন্তুষ্টিকে জোচ্চুরির পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তবে একটু অন্যভাবে। দেশে এখন এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা চলছে। আরেক প্রতিষ্ঠান দারাজ নিয়েও সমাজের অনেকেরই অসন্তুষ্টি-অভিযোগ আছে।
আমরা খবরের মাধ্যমে জেনেছি ২০১৮ সালে ই-কমার্সের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ই-ভ্যালি। পরিচিতি বৃদ্ধির জন্য কোম্পানিটি প্রতিযোগিতামূলক পণ্যমূল্যের ওপর মনোনিবেশ করেছিল। মোটরসাইকেল, গাড়ি, মোবাইল ফোন, ঘরের সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্রের মতো উচ্চমূল্যের পণ্যে লোভনীয় মূল্য ছাড় দিয়ে আলোচনায় আসে তারা। প্রতিষ্ঠার শুরুতে ‘সাইক্লোন’, ‘আর্থকোয়েক’ ইত্যাদি নামে তারা ক্রেতাদের ১০০ শতাংশ, ১৫০ শতাংশ ক্যাশব্যাকের মতো অত্যন্ত লোভনীয় অফারও দেয়। তাদের ব্যবসার এই কৌশলের ফলে মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। ই-ভ্যালি, বাংলা চলচ্চিত্র ‘মিশন এক্সট্রিম’ এবং ‘মিশন এক্সট্রিম-২’-এর পৃষ্ঠপোষকতাও করে, খেলাধুলাতেও তারা স্পন্সর করেছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ‘চ্যানেল আই মিডিয়া পুরস্কার-২০২০’-এ ই-ভ্যালি ই-কমার্স বিভাগে সেরা কোম্পানি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। ২০২০ সালের নভেম্বরে, ই-ভালি তাদের খাদ্য সরবরাহ পরিষেবা ‘ই-ফুড’-এর জন্য ‘ই-সিএবি’ কর্র্তৃক ‘ই-কমার্স মুভার্স অ্যাওয়ার্ড’ (ইসিএমএ) পেয়েছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন এশিয়াওয়ান ই-ভ্যালিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফলে এর গ্রাহক অতি অল্প সময়ে তর তর করে বাড়তে থাকে। এত কিছুর পরেও আজ কেন ই-ভ্যালির ব্যবসা বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন চলে আসে। এদের ফাঁদে মানুষ কেন পা দিচ্ছে?
আমাদের দেশে ফটকাবাজি নতুন কিছু নয়, ডেসটিনির নাম আমরা অনেকেই জানি। নব্বই দশকে ‘সাফা’ নামের এক কোম্পানি অনেককেই পথে বসিয়েছিল। ডিজিটালাইজেশনের কারণে মানুষের এই ফটকাবাজিও আধুনিক স্টাইলে হচ্ছে। পাশাপাশি অনেকেই এই ই-কমার্সকে বিনিয়োগের মাধ্যম ভাবছেন। কিন্তু কেন? এর উত্তর খুব সহজ। আমাদের দেশে আগের তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে অনেক গুণ। কিন্তু সেই তুলনায় বিনিয়োগের সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সঞ্চয়-জিডিপির অনুপাত ৪০ শতাংশের ভেতরে অবস্থান করে। এ সঞ্চয়কে আমরা বিনিয়োগে রূপ দিতে পারিনি। সাধারণ জনগণ ব্যাংকে টাকা রাখে, সরকারি বন্ড ক্রয় করে আর কিছু কিছু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। সুদের হার কমে যাওয়ার ফলে সেই সব জনগণের আজ বিনিয়োগের কোনো জায়গা নেই। শেয়ারবাজারের ঝুঁকি ও অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায় অনেকেই বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছে বা পায়। দেশে আরেক ধরনের প্রচারণার কারণে আজকাল আরেকটি গোষ্ঠী ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ নিতে রাজি নন। জনগণের একটা অংশ ব্যাংকে টাকা রাখলেও সেই সুদ থেকে কর কেটে নেওয়ার ফলে অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। আবার মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের প্রকৃত আয় যা হচ্ছে তার মূল্য কমে যাচ্ছে। করোনার কারণে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে অলসভাবে সময় কাটানো যুবকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই যুবকরাই এই জাতীয় ই-কমার্সের মূল গ্রাহক। বেশি লাভের আশায় এই শ্রেণির মানুষ ও অশিক্ষিত জনগণ ই-ভ্যালির ফাঁদে পা দিচ্ছে। জন্ম হচ্ছে এমন শত শত কোম্পানির।
কিন্তু যথাযথ তদারকির অভাবে এসব কোম্পানির বিকাশও ঘটছে না। ই-কমার্সের জন্য আলাদা আইন করে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, জাতীয় প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও কার্যকর করে এই ব্যবসাকে আরও গতিশীল করা যেতে পারে। প্রতিযোগিতা কমিশনের পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকেও আরও প্রফেশনাল হতে হবে। তাদের আরও ক্ষমতা দিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে। বাজার বিশ্লেষণ, অসম প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। আমাদের দেশের মূল সমস্যা হলো, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব। কোনো চিন্তাভাবনা পরিপূর্ণভাবে না করে কিংবা এর ফলাফল আগাম চিন্তা না করেই আমরা কোনো একটা বিষয় শুরু করে দিই। যেহেতু এই ব্যবসা এখনো নতুন, যারা ক্রেতা বা ভোক্তা তাদেরও শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এই উদীয়মান খাতকে আরও টেকসই কীভাবে করা যায় তার জন্য নীতিমালা ও শক্ত গঠনতন্ত্র খুব দরকার। ই-কমার্স সংক্রান্ত প্রচার ই-ক্যাব কিন্তু বছরজুড়েই করতে পারে। কেননা একটি ব্যবসায়িক সংগঠক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ই-ক্যাব ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে থাকে। ই-কমার্স কেন্দ্রিক সফল উদ্যোক্তা হতে হলে ব্যবসা শুরুর আগে সঠিক ধারণা অর্জন, মূলধনের জোগান এবং কবে থেকে মুনাফা আসবে তার একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। এ ব্যবসার জন্য পণ্য নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। উদ্যোক্তা যে পণ্যগুলো সম্পর্কে ভালো জানেন এবং বোঝেন সেই পণ্যগুলো নিয়েই কাজ করা উচিত। এমন পণ্য নির্বাচন করতে হবে যে পণ্যগুলোর চাহিদা আছে। পণ্যগুলোর সংগ্রহ এবং ক্রেতার কাছে জোগান দেওয়ার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে ব্যবসায় খারাপ প্রভাব পড়বে। পণ্যের গুণগত মানের দিকে সচেতন থাকা দরকার। এখন মার্কেটিংয়ের নানা মাধ্যম এবং কৌশল রয়েছে যা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার, সঠিক বিজ্ঞাপন/মার্কেটিং ব্যবসাকে সফল করবে। ই-কমার্স করতে গেলে সবার প্রথম যে বিষয়টি মাথায় আসে তা হলো একটি ওয়েবসাইট, যা ব্যবহার করে সবাই কেনাকাটা করতে পারবে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্লাটফর্ম, সঠিক প্রযুক্তি নির্বাচন করা এবং যথাযথ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা। সাধারণ ক্রেতা যেন সহজেই এই ব্যবসার ধরন বুঝতে পারে। অর্থাৎ ডোমেইন নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি হোস্টিং-এর মান যাতে ভালো হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
ই-কমার্সের জন্য মুড অব পেমেন্ট আরেকটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কোনো পণ্য ক্রয় থেকে শুরু করে সেই পণ্যটির মূল্য কীভাবে গ্রহণ করবেন অথবা ক্রেতা কীভাবে সেই মূল্য পরিশোধ করবেন সেটি আগেই ঠিক করে নিতে হবে। পেমেন্ট অনেক ধরনের হতে পারে। আমাদের দেশে ক্যাশ অন ডেলিভারির মাধমেই বেশি লেনদেন সম্পন্ন হয়। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়ে থাকে। ক্রেতা যেন খুব সহজে তার কোনো মূল্য পরিশোধ করতে পারেন সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। পণ্য অর্ডার থেকে শুরু করে কত সময়ের মধ্যে এবং কোন মাধ্যমে পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। ডেলিভারি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো পণ্যের মান সঠিকভাবে যাচাই করে তারপরই ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার প্রতি লক্ষ রাখা অতি জরুরি। পণ্য বিক্রয় পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে ক্রেতাকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা আবশ্যক। এমন অনেক পণ্য থাকে যা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে; সেক্ষেত্রে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন সঠিকভাবে হওয়া জরুরি। ক্রেতাকে ভুল কোনো তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি না করা ভালো। এর ফলে ব্যবসার ওপর একটা ভালো প্রভাব পড়বে। সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে মোবাইল, টেলিফোন, ই-মেইল অথবা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। তরুণ প্রজন্ম এখন পুরোপুরি তথ্য এবং প্রযুক্তিনির্ভর। ডিজিটালাইজেশনের যুগে ই-কমার্স হতে পারে তরুণদের ভরসার জায়গা। হতে পারে অনেকের কর্মসংস্থান। শুধু দরকার সঠিক নিয়মের ভেতরে একটা ভিত্তি গড়ে দেওয়া। ই-কমার্স হোক বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ের ভরসার স্থল।
লেখক ব্যাংকার ও গবেষক
liplisa7@gmail.com