বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার তার সরকারের নেয়া চারটি কৌশলগত কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত তিন ধাপে কার্যকর করা হবে।
তিনি বলেন, সরকার গৃহীত চারটি কর্মসূচি হলো সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা, আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি এবং মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা।
শেখ হাসিনা বলেন, এসব কর্মসূচি অবিলম্বে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট তিন মাসে, স্বল্পমেয়াদে আগামী অর্থবছরে এবং মধ্যমেয়াদে পরবর্তী তিন অর্থবছরে- এ তিন ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে।
‘বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা আমাদের অর্থনীতির জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি না এ সংকট কত দিন থাকবে এবং কীভাবে এটি আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। তবে আমরা সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য কাজ করছি,’ বলেন তিনি।
সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বাংলা নববর্ষ ১৪২৭ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন। এছাড়া বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং রেডিও স্টেশনগুলো এ ভাষণ সম্প্রচার করেছে।
প্রায় ১৬ মিনিটের বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, সরকার ইতোমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে যা জিডিপির ৩.৩ শতাংশ।
প্রান্তিক জনগণকে রক্ষায় সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করার জন্য সরকার ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ১ লাখ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ করেছে এবং এ বরাদ্দের বাজার মূল্য ২ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা।
শহরাঞ্চলে বসবাসরত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ওএমএসের আওতায় ১০ টাকায় চাল বিক্রি শুরু হয়েছে এবং এ কর্মসূচির আওতায় ৭৪ হাজার মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হবে। সরকারকে এ জন্য ২৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হয়েছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, রিকশা বা ভ্যান চালক, পরিবহন শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, সংবাদপত্রের হকার, হোটেল কর্মচারী, দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমিক এবং আংশিক লকডাউনের কারণে চাকরি হারানো অন্যান্য পেশার মানুষদের একটি তালিকা দ্রুত প্রস্তুত করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তালিকা তৈরির পর তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে এককালীন নগদ টাকা পাঠানো হবে। এ জন্য মোট ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সর্বোচ্চ দারিদ্র্যপীড়িত ১০০ উপজেলায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ‘বার্ধক্য ভাতা’ এবং ‘বিধবা ও স্বামী-পরিত্যক্ত মহিলা ভাতা’ শতকরা এক শতাংশে উন্নীত করা হবে। এ কর্মসূচির জন্য বাজেট ৮১৫ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনের লক্ষ্যে দেশের সকল গৃহহীন মানুষের জন্য ঘর সরবরাহের কর্মসূচিও দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।
‘এ লক্ষ্যে ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে এবং কেউ গৃহহীন থাকবে না,’ যোগ করেন শেখ হাসিনা।
‘মনোবল হারাবেন না’: স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী
চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সংকটের সময়ে আপনারা মনোবল হারাবেন না। পুরো জাতি আপনাদের সাথে আছে।
তিনি বলেন, ‘চিকিতৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি উপেক্ষা করে প্রথম থেকেই কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা সরবরাহ করে চলেছেন। আপনাদের পেশা চ্যালেঞ্জের। সংকটের এ সময়ে মনোবল হারাবেন না। দেশের মানুষ আপনাদের পাশে রয়েছে।’
দেশের জনগণের পক্ষে স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ ও প্রশংসা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সাথে সরাসরি কাজ করেন এমন স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দিয়েছে।
বিশেষ সম্মানী এবং স্বাস্থ্য বীমা:
স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মাননা দেয়ার লক্ষ্যে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, চিকিৎসক, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবির সদস্য এবং এ ক্ষেত্রে সরাসরি নিযুক্ত অন্যান্য সরকারী কর্মচারীর জন্য একটি বিশেষ স্বাস্থ্য বীমা চালু করার প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি জানান, যদি কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন তাহলে পদের উপর নির্ভর করে সেই ব্যক্তির জন্য ৫-১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্য বীমা করা হবে এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে বীমার পরিমাণের পাঁচ গুণ টাকা প্রদান করা হবে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বীমা ও জীবন বীমার জন্য ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
সুরক্ষা সরঞ্জামের সংকট নেই:
সুরক্ষা সরঞ্জামের কোনো ঘাটতি নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেকে সুরক্ষিত রেখে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাবেন বলে দেশবাসী প্রত্যাশা করে।
সেই সাথে তিনি সাধারণ রোগীরা যাতে কোনোভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হন, সে দিকে নজর রাখার জন্য প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে নিয়োজিত পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, মিডিয়া কর্মী, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী আনা-নেয়ার কাজে এবং মৃত ব্যক্তির দাফন ও সৎকারের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীসহ জরুরি সেবা কাজে যারা নিয়োজিত রয়েছেন তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক টুকরো জমিও অনাবাদি রাখবেন না:
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কৃষি পণ্যের নিয়মিত উৎপাদন পর্যাপ্ত হবে না। ভয়াবহ সংকটের এ সময়ে তা বাড়িয়ে তুলতে হবে। কোনো জমি অনাবাদি অবস্থায় ফেলে রাখবেন না, যাতে আগামী দিনগুলোতে দেশে কোনো খাদ্য সংকট না হয়।’
তিনি বলেন, সরকার বীজ, সার ও কীটনাশকসহ সকল প্রকারের কৃষি উপকরণ সময়মতো কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
কৃষকদের বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার গত মৌসুমের তুলনায় অতিরিক্ত ২ লাখ মেট্রিক টন ধান ও চাল সংগ্রহ করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ লক্ষ্যে কৃষি যন্ত্রপাতির জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, কৃষি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হচ্ছে। এ তহবিল থেকে কৃষি, মৎস্য, দুগ্ধ ও পোল্ট্রি খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের মাঝে চার শতাংশ সুদ হারে ঋণ বিতরণ করা হবে। এছাড়া কৃষি খাতে ভর্তুকি হিসাবে সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
এখন কোনো খাদ্য সংকট নেই:
তিনি বলেন, দেশে এখন কোনো খাদ্য সংকট নেই কারণ সরকারি গোডাউন (গুদাম) এবং কৃষকদের ঘরে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য রয়েছে।
চলতি মৌসুমে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি মৌসুমে বোরো ধারেনও বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করা যায়।
খাদ্য ও কৃষি পণ্য সরবরাহ ও বিতরণ বজায় রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, যোগ করেন তিনি।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করুন:
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক জনহিতৈষী ব্যক্তি ও সংস্থা এ সংকটের সময়ে দরিদ্রদের জন্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন। তবে সমবণ্টনের জন্য আলাদাভাবে না দিয়ে এ ত্রাণ সামগ্রী এবং সহায়তা স্থানীয় সরকার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা উচিত।
তিনি ধনী ব্যক্তিদের দরিদ্রদের জন্য তাদের সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং করোনভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
পহেলা বৈশাখ:
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার পহেলা বৈশাখ উদযাপনে সকল বহিরাঙ্গণ কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
‘এটি বৃহত্তর জনস্বাস্থ্যের অবস্থার কথা চিন্তা করেই করা হয়েছে। কারণ, ইতিমধ্যেই এ ভাইরাসটি আমাদের দেশেও ভয়াবহ আকার ধারণ করা শুরু করেছে’ যোগ করেন তিনি।
আতঙ্কিত হবেন না, সরকার আপনাদের সাথে রয়েছে:
প্রধানমন্ত্রী সকলকে ভীত বা আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এটি মানুষের প্রতিরোধ শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।
তিনি বলেন, ‘আতঙ্ক ছড়াবেন না, আমাদের সকলকে সাহসের সাথে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে এবং সরকার সর্বদা আপনার পাশে রয়েছে।’
স্বার্থান্বেষী কিছু মহল গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এ সংকটময় মুহূর্তে গুজব ছড়ানো মোটেই কাম্য নয়। দয়া করে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না ‘
এ মহামারি মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তা করার জন্য গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীলতার সাথে সঠিক তথ্য প্রকাশ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
‘যে অন্ধকার আমাদের ঘিরে রেখেছে, তা এক দিন দূর হয়ে যাবে’, বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।