হেমন্তের ভেজা সূর্য
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ৮:১৩:১৩
রোকেয়া ইসলাম :
উঠোনে ঘুঘু ছন্দময় পায়ে হাঁটছে।
‘কবুতর পালে কে?’
‘এইডা তো কইতর না এইডা ঘুঘু।’
‘ঘুঘু এখানে কেন?’
‘আমাগো উঠানে ঘুঘু আহে, মুরগিকে খুদ কুঁড়া দিই হেগুনা টোকাইয়া খায়।
তাই!’
‘হ ধান তো অহন তরি পাকে নাই।’
‘ওরা তো পোকা ধরে খায়।’
‘একপদ আর কত খাইব। ক্ষেতে তো হাজারে বিজারে ঘুঘু আহে।’
‘কী সুন্দর করে হাঁটছে ঘুঘু।’
‘ঘুঘুর গুস্তো খাইবেন। ফাঁদ পাইতা ঘুঘু ধরি, রাইন্ধা দিমুনে।’
‘আরে নানা ঘুঘু ধরতে হবে না, ওদের থাকতে দাও ওদের মতো।’
আরো দুটো ঘুঘু উড়ে এসে খুদ টুকাতে থাকে।
‘আমার দুলাভাই আইছিলো হে ফাঁদ পাইতা ঘুঘু ধরছিলো।’
‘ধরা সহজ বাঁশের চটা দিয়া ফাঁদ বানাইয়া থুইয়া দিলে একটা ঘুঘু পড়লে হেই আরো ঘুঘুরে ডাইক্কা লইয়া যায়।’
‘আরে বলে কি তাহলে তো বেইমানি করে অন্য ঘুঘুদের সঙ্গে।’
ঘুঘুর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। ইভা ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মিলি ঘরে ঢুকে না ওর সাথে।
দরজাটা চাপিয়ে দেয়া দরকার, মিলিকে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আর ডাকলেও ধারে কাছে যে ও নেই এটা সুনিশ্চিত। চঞ্চলা হরিণীর মতো কোথায় ছুটে গেছে কটকটি বুড়ি কে জানে, ওর মা বলেছে তার মেয়েটি সারাদিন এপাড়া ওপাড়া ঘুরে বেড়ায় আর কটকটিয়ে সবার সাথে কথা কয়।
পাড়াবেড়ানি কটকটি বেগম নেই তাই ইভা উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফ্যানটা ছেড়ে আবার শুয়ে পড়ে।
‘আড়া কচকচানি পাখিটা জানালার কাচ ঠুকরে ঝগড়া করছে।’
‘ওদের ঝগড়া দেখতে খারাপ লাগছে না। মায়া লাগছে।’ নিজের ছবিটা জানালায় দেখে নিজেই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ঠুকরে দিচ্ছে শক্ত কাচে। ব্যথা পাচ্ছে ঠোঁটে।
ইভাও কি মাঝে মাঝে নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করে না? ওর সামনে দুই ইভা দাঁড়িয়ে যায়, কেউ কাউকেই ছাড় দিতে চায় না।
এবারও কি শুধু নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য অজ্ঞাত বাস ওর। অজ্ঞাত বলা যাবে না সবাই ওর অবস্থান জানে। নিরিবিলি বাস বলা যেতে পারে এটাকে। নিজের সঙ্গে নিজের রুদ্ধদ্বার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক।
তাতে এতো সময় নির্ধারণ কেন? এখনই হোক।
ইভা দেখতে পাচ্ছে দুজন মুখোমুখি বসে প্রচণ্ড আক্রমণ করছে পরস্পরকে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না, দরজা ধাক্কানোর শব্দে জেগে বুঝতে পারে বেশ অনেকক্ষণ হবে।
দরজা ঠেলে মিলি ঘরে ঢুকে, ‘নদীর পাড়ে যাবাইন না? নইন যাই। পরতিবার তো হাইঞ্জাকালে বইসা থাকুন পানির বোগলে।’
‘চল যাই।’
চুল টেনে বেঁধে পরনের শাড়িটা ঝেড়ে পরে।
নদীর দুই পাড়ে বেশকিছু দোকান তৈরি হয়ে বিক্রিবাট্টা শুরু হয়েছে। খুচরো ব্যবসায়ীরা চটপটি ফুচকা ঝালমুড়ি নিয়ে আসে দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে বসে আড্ডা দেয় অনেকে। বয়স্করা যে দোকানে বসে যুবকরা তার ধারেকাছেও যায় না। মুরুব্বিরা বাংলা চলচ্চিত্র দেখে গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। যুবকরা অন্য দোকানের বেঞ্চে বসে মোবাইল টিপে সিগারেট ফোঁকে। ছোকড়ারা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বসে মোবাইল টিপে চটপটি ফুচকা খায় যুবকদের ঝালমুড়ির গামলার পাশে ঘেঁষে। শ্রমিকরা সারাদিন ঘাস কেটে বোঝা বানিয়ে খেয়া নৌকায় এপাড়ে ফেরে, এপাড়ের কাজ শেষে ওপাড়ে যাওয়ার জন্য নদীর পাড়ে দাঁড়ায় যাত্রীরা। নৌকায় মাছ ধরে ফেরে কেউ রাতের ক্ষেপে মাছ ধরতে যাওয়ার লোকজন প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
অটো ভ্যান সাইকেল হোন্ডা যার যার কর্মব্যস্ততার শব্দ তুলে যাচ্ছে। মানুষও কথা বলতে বলতে পথ ফুরিয়ে হাঁটছে। নদী ঘিরেই কর্মকাণ্ড চলছে শতশত, নদীও ভ্রƒক্ষেপহীন বয়ে চলছে। গ্রামীণ অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে বদলের ছাপ পড়ছে জীবনযাত্রায়ও।
ইভা বেঞ্চে বসে চারদিক দেখতে থাকে। গ্রামীণ এই ব্যস্ততা ওর কাছে অবাক হওয়ার বিষয় নয়। ও রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকায় বসবাস করে, ওর বাড়ির সামনের রাস্তা দিনরাত জেগে থাকে জীবনের কলরবে। তবু গ্রামের বাড়ির এই দৃশ্য এই জীবনের কলরব ওর খুব ভালো লাগে, অদৃশ্য মানসিক নৈকট্য অনুভব করে।
গাছের পাতায় পাতায় সূর্যের বিদায়ের আগাম বার্তা ছুঁয়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে সন্ধ্যা আসছে। এই সময়টা গভীরভাবে অনুভব করতে হয়। ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে সত্তায় জেগে থাকে নিবিড় বোধ।
সামনের নদীর জলে মৃদু পায়ে নামছে সূর্য। আগুন রাঙা সূর্য জলে নীরবে জ্বেলে দেয় আগুন। এই রক্তিম আগুনটা কি প্রেমের না বিরহ বেদনার। গভীর প্রেম না হলে সুগভীর বিরহ কেন? এটা কি সমর্পণ? কে সমর্পিত হলো সূর্য না জল।
হঠাৎ ইভার চারপাশজুড়ে প্রবল নীরবতা। গাছের পাতা নড়ছে জল বইছে তবু সমস্ত প্রকৃতিজুড়ে নিবেদনের নীরবতা নিস্তব্ধতা।
ইভা তাকিয়ে থাকে জলে ডোবা সূর্যে। রাতের খাবারে হাঁস নেই মুরগি নেই ঘুঘুও নেই, সবজি ডাল ভর্তা। অনেক স্বস্তি নিয়ে খাবার শেষ করে।
‘কাইল বেয়ানকালে কী খাবাইন?’
‘যা হয় একটা কিছু করে দিও।’
‘কাইল গুঁড়ি কুইট্টা রুটিপিডা বানাইয়া দিও লগে গোশত রাইন্ধো।’
মায়ের পাশ দিয়ে মিলি কটকটিয়ে কথা বলে।
‘না সকালেই গোশত টোশত খাব না তুমি সবজি করবে রুটির সাথে।’
‘গুস্তো দিয়া রুটি খাইতে খুব সোয়াদ হেইডা জানুইন না। সোয়াদডাই বুঝলাইন না গো।’
মিলির পাকা কথায় হেসে দেয় ইভা।
রাশিদা মিলি যা খেতে চায় ওকে করে দিও কাল।
‘একলা খাইয়া মজা নাইকা ব্যহে মিল্লা খাইলে কম হইলেও সোয়াদ বেশি।’
‘ঠিক আছে কাল লতিফকে নদীর ছোট মাছ আনতে বলবে সবাই মিলে আনন্দ করে খাব।’
‘আপনে হইলেন শহইরা ধনী মানুষ, খাবাইন পুলাও গোশত তা না খাইন খালি বর্তা শাকপাতা তরকারি। এগুনা তো গরিবের খাওন। টোহাইয়া আনি মা রান্ধে আমরা খাই। ট্যাহা নাই বাজার করনের।’
‘ঠিক আছে তোমার পছন্দের খাবার কাল খাবে।’
‘আপনে কি এলকাই থাকবেন ঘরে।’
‘হ্যাঁ।’
‘ডরাবাইন না।’
‘না আমি ডরাই না, আমার সাহস আছে।’
ইভা ওকে বলে না নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধটা এখনও অমীমাংসিত, আজ রাতেই শেষ করতে হবে। তার জন্য ওকে একা থাকতে হবে।
যুদ্ধ শুরুর আগে পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নেয়। কাল মিলিকে নিয়ে উপজেলার মার্কেটে যাবে ওর পছন্দের জামাকাপড় কসমেটিক কিনে কোন ভালো হোটেল ওকে খাওয়াবে।
মেয়েটাকে ভালো লেগেছে ইভার। ওর কথা ওর বুদ্ধি ওর বয়সে নেই এগিয়ে গেছে। প্রকৃতি ওকে জীবনের বাঁক চেনাচ্ছে। বোধ পোক্ত করছে। ঋতুতে এখন হেমন্ত।
শেষ রাতে একটু ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। ওঠে ফ্যানটা বন্ধ করে দিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।
ডুপ্লেক্স পূর্বমুখী দরজা খুলে দিতেই হিমহিম বাতাস ঢুকে পড়ে দরজা দিয়ে।
এই মৃদু বাতাস গায়ে আরাম দিচ্ছে। পাতলা কাঁথা বুক অবধি টেনে দেয়।
কাল অনেক রাত অবধি যুদ্ধ করেও কেউ জিততে পারেনি। দুজনের হার তো মানা যায় না, একজনকে তো জিততেই হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ভাবনাটা আটকে যায় ইভার ভেতরে। এটা এমন এক যুদ্ধ যেখানে একজন হারলেও জিতবে দুজনেই।
‘কাকে হারাবে ইভা, কে জিতবে? এখানে ইভার ভূমিকা কী? প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেয়। আর যুদ্ধ করার শক্তি, ইচ্ছে নেই। ক্লান্ত হয়ে গেছে ইভা।
সঙ্গে সঙ্গে জিতে যায় একজন হেরে যাওয়া সত্তাও উল্লসিত হয়।
দূরের মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট, রাগ ভৈরবী সুর গাছের সবুজ ছুঁয়ে পোয়াতি ধানের ক্ষেতে সুবাস মেখে জাগানিয়া পবিত্র বাণী নিয়ে বাতাসে ভেসে আসছে ইভার কাছে। কলাপসিবল গেটের তালা খুলে নেমে পড়ে উঠোনে।
সদর দরজাও কঠিনভাবে আটকানো। নিজের ভেতরের শক্ত বাঁধনকেই সহজ হাতে খুলতে পেরেছে ইভা, আর লোহার গেটের লোহার তালা চাবি দিয়ে খোলা তো আঙুলের মোচড়। আইল ধরে ধানের ক্ষেতের পাশে এসে দাঁড়ায়।
হিমেল হাওয়ায় ভাসছে ভেজা গন্ধ। অপার্থিব নরম আলো ঝুরো ঝুরো হয়ে পড়ছে পৃথিবীতে। বড় করে শ্বাস টানে সম্ভাবনাময় ধানের গন্ধ নিয়ে। শ্বাসটা যতক্ষণ ভেতরে থাকবে ততক্ষণই জীবনের জয়গান। নিশ্বাসের সঙ্গে চলেও যেতে পারে ভালোবাসার জীবন বায়ু। তবু আস্তে নিশ্বাস ছাড়ে।
ততক্ষণে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। ভেজা বাতাস আরামদায়ক তাপ পেয়ে সোহাগি হয়ে গেছে। হাত বাড়িয়ে হেমন্তের রোদ ছোঁয়। বসে পড়ে ভেজা ঘাসে। ধানের পাতায় পাতায় শিশির। ধানের পাতাকে নিরীহ দেখা গেলেও অসাবধানে হাত নাড়াচাড়া করলে ঘসঘসে ধারালো পাতায় হাত কাটার সম্ভাবনা বিপুল। আলতো করে হাত রাখে পাতায়। টুপটাপ শিশির হাতে মেখে যায়। শিহরিত হয়ে মুঠ পাকিয়ে ফেলে ইভা। আলগোছে মুঠো খুলে দেয়। রোদের ঝিলিকে শিশির ঝলমল করে ওঠে। দুহাতের কলতলে তাকিয়ে রোদ আর শিশিরের মাখামাখি খেলা দেখে।
আকাশে তাকায় ইভা, কে কার? সূর্য শিশিরের না সূর্যের শিশির। মিলি এসে পাশে দাঁড়ায়।
‘আপনে একাই বইসা রইছেন ক্যা। আমারে ডাকলেই তো লগে আইতাম।’
‘আমি তো একা নই।’
ধানক্ষেত প্রজাপতি উড়ছে আনন্দে। হেমন্তের মিহি কুয়াশার আকাশ চারপাশে হেমন্তের গন্ধ ছোঁয়া ঋতু।
ইভার প্রবল বিশ্বাসের দৃষ্টিতে মিলির অবাক চোখ কী যেন খোঁজে…।