ট্রাম্পের ২.০: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কী কী পরিবর্তন আসবে?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৫:৩০
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইতিহাস গড়লেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান এই প্রার্থী ১৩২ বছরের নির্বাচনি রেওয়াজ ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। বিগত ১০ নির্বাচনের ৯ টিতেই নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা মার্কিন অধ্যাপককেও এবার তুড়ি মেরে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন ৭৮ বছর বয়সি এই রাজনীতিক।
আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার এখন বাকি থাকলেও হোয়াইট হাউসের রঙিন জীবন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। সরকারিভাবে ফল ঘোষণার আগেই বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে ফার্স্ট লেডি মেলানিয়াকে নিয়ে সাদা ঘরের বাসিন্দা হতে ট্রাম্পকে আরও অপেক্ষা করতে হবে ৭৪ দিন।
এখন পর্যন্ত যে ফল ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে— ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫৩৮ টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে পেয়েছেন ২৯৫টি। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ২২৬ টি। যদিও সংখ্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পরিসংখ্যানে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ফল নির্ধারক ৭ টি সুইং (দোদুল্যমান) স্টেটের মধ্যে ৫টিতেই জয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফল ঘোষণার বাকি নেভাদা ও অ্যারিজোনায়ও এগিয়ে রয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী। এই দুটিতে ইলেকটোরাল ভোট যথাক্রমে ৬ ও ১১ টি। এই দুটিতে ট্রাম্প জিতে গেলে ‘উইনার টেকস অল’ মার্কিন নীতি অনুযায়ী তার ইলেকটোরাল ভোট হবে ৩১২। সুইং ছাড়া আরও দুটি রাজ্যে ফল ঘোষণা বাকি; সে দুটি হচ্ছে মেইন ও নেব্রাসকা। সেগুলোতে ইলেকটোরাল ভোট যথাক্রমে ৪ ও ৫ টি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ের আভাস পাওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা নড়েচড়ে বসেছেন। ক্ষ্যাপাটে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্রনীতি কোন পথে এগোবে সেটি নিয়ে হিসাব নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনবেন কি ট্রাম্প? বাইডেন প্রশাসনের অনুসৃত নীতিতে কী কী পরিবর্তন আনবেন তিনি।
রেশনাল অ্যাক্টর প্যারাডাইম ও বাস্তববাদী তাত্ত্বিক হেনস জে মরগানথুর রিয়েলিজম থিওরি (বাস্তববাদ) অনুযায়ী, ডোনাল্ড ট্রাম্প হচ্ছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একজন ইরেশনাল অ্যাক্টর; যিনি অনুনমেয় চরিত্র। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তিনি কখন কী সিদ্ধান্ত নেন, কাকে কী বলে উঠেন তা অনুমান করার সাধ্য কারো নেই। তার প্রথম মেয়াদে নেওয়া পদক্ষেপগুলো দিকে লক্ষ্য করলে সেটি বোঝা কঠিন নয়। একজন নন্দিত ও নিন্দিত রাষ্ট্রনায়কের মিশ্রণ ট্রাম্পের চরিত্রের মধ্যে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ফৌজধারী অপরাধ প্রমাণিত হওয়া প্রথম প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া ট্রাম্প। ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংকটে মিত্র শক্তিগুলোকে ডেমোক্র্যাট বাইডেন প্রশাসন অবারিত সামরিক-অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিই যখন টালমাটাল অবস্থা তখন মার্কিনিরা নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে ও ভাগ্য বদলানোর তাগিদে ট্রাম্পকে বেছে নিয়েছেন।
শাসক শ্রেণির এক্সেস পাওয়ার কখনোই কোনো রাষ্ট্রের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। এটি জানার পরও মার্কির্নিরা ট্রাম্পকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছেন। বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটির পার্লামেন্টের সিনেট, হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস, প্রাদেশিক পরিষদ তথা গভর্নর সব জায়গায় এবার রিপাবলিকানদের জয়জয়কার। এতো ম্যান্ডেটের পর ট্রাম্পকে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে বিরোধীদের মুখ চেয়ে থাকতে হবে না। চাইলেই তিনি আইন পাশ করতে পারবেন। মাত্রাতিরিক্ত এই ক্ষমতা ট্রাম্পকে কোথায় নিয়ে যায় সেটিই দেখার বিষয়। আগ্রাসী নীতির কারণে চার বছর আগে একবার ট্রাম্পকে ছুঁড়ে ফেলেছিল মার্কিনিরা। এবার বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মসনদে ফিরছেন। ট্রাম্পের এই সময় বিশ্ববাসীর জন্য কতটা ভোগান্তির হবে সেটিও ভাবনার বিষয়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইউক্রেন ও চীনের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের উদার নীতির পরিবর্তে ট্রাম্প শক্ত নীতি নেবেন। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি কী হবে তা এখনই অনুমান করা মুশকিল।
নির্বাচনি প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন ও মুদ্রাস্ফীতির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি তার ‘আমেরিকান ফার্স্ট’ নীতি ফিরিয়ে আনার ইঙ্গিত করেছেন বারবার। বিচ্ছিন্নতাবাদ ও বৈশ্বিক কোলাবোরেশন কমিয়ে আনার ইঙ্গিতও করেছেন তিনি।
নির্বাচনি প্রচারে ট্রাম্প জয়ী হলে ইউক্রেন যুদ্ধ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধের কথা বলেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনয়ন ও বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের লাগাম টেনে ধরার কথাও বলেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ট্রাম্পের কথার সঙ্গে বিস্তর ফাকার থাকতে পারে তিনি আদতে কী করতে পারবেন সে বিষয়ে। ট্রাম্প তার কথায় অনঢ় থাকতে পারবেন কিনা সেটি নিয়েও বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ইসরাইল সবচেয়ে ‘ভালো বন্ধু’
ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ায় বোধহয় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন ‘মধ্যপ্রাচ্যের কসাই’ বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ট্রাম্পের জয়ের পর অভিনন্দন জানাতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে বন্ধু সম্বোধন করেছেন। আগের মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকতে ট্রাম্প তার দেশের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছিলেন। এর মাধ্যমে জেরুজালেমে ইসরাইলের দখলদারিত্বের অনেকটাই স্বীকৃতি দেন ট্রাম্প। যেটি ফিলিস্তিনিদের মনে দাগ কেটেছিল। সিরিয়ায় ইসরাইলের দখল করা গোলান মালভূমিরও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন রিপাবলিকান এই নেতা। আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভিত্তিভূমি আব্রাহাম অ্যাকর্ড ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসি থিংক ট্যাংকের সিইও ন্যান্সি ওকাইল বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন-মধ্যপ্রাচ্য সংকট সমাধানের উপায় হচ্ছে সেখানে অনুদান ছুঁড়ে দেওয়া। ন্যান্সি মনে করেন, তদুপরি ট্রাম্প চাইলেই মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে পারেন। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তির জন্য অস্ত্র’ মার্কিন নীতি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। গাজা ও লেবাননে ইসরাইলের এই নীতিই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি ডেকে এনেছে। তাই ইসরাইলকে অস্ত্র সরবারহ কমিয়ে দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইলে মধ্যপ্রাচ্যের আগুন প্রশমিত করতে পারেন।
ইরানের সঙ্গে শত্রুতা
ইরানকে জাত শত্রু ভাবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে এবং পরেও ইরানের বিষয়ে কট্টর নীতিতে বিশ্বাসী ক্ষ্যাপাটে ট্রাম্প। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ রাখার শর্তে তেহরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার তুলে নেওয়ার চুক্তি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ কয়েকটি পক্ষের। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এরপরই ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের ওপর বেশ কয়েকটি কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের স্বীকৃতিও এসেছিল ট্রাম্প জমানায়। চলতি বছরের অক্টোবরে নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে ট্রাম্প সেই নীতি স্মরণ করে বলেন, আমি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলাম তখন ইরান ছিল শূন্যাবস্থায়। তারা চারদিক থেকে আবদ্ধ ছিল, তাদের অর্থ ছিল না। এতে বোঝা যায় ট্রাম্প তার ইরান নীতিতে কট্টর অবস্থান থেকে সরে আসবেন না।
সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসি থিংক ট্যাংকের সিইও ন্যান্সি ওকাইল আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ট্রাম্পের আগামী মেয়াদে বিশ্ব পরমাণবিক বিস্তার দেখতে পারে। লেবান ও ইরানে যুদ্ধের যে বিস্তার যার গতি যুক্তরাষ্ট্র থামানোর কথা বলছে, ট্রাম্প চাইলেই সেটি সম্ভব। সেখানে সংঘাতও কমিয়ে আনা সম্ভব।
ইউক্রেন যুদ্ধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবেন বলে মনে করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘আমি যদি প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসি এই যুদ্ধ বন্ধে আমার এক দিন সময় লাগবে।’ কীভাবে সেটি সম্ভব এমন প্রশ্নের বিশদ উত্তর না দিয়ে ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারের সময় বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বসতে চান। তাদের দুজনেরই দুর্বলতা ও শক্তি সম্পর্কে তার জানা আছে। তাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই যুদ্ধ বন্ধের সক্ষমতা আছে বলে আত্মবিশ্বাসী ট্রাম্প।
পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সাহায্য দিতে জেলেনস্কির আবেদনের সমালোচনাও করেছেন। জুনে ট্রাম্প বলেছিলেন, ক্ষমতায় গিয়েই তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন।
লন্ডনের চেতহাম হাউসের থিংক ট্যাংক লেসলি ভিনযামুরির মতে, ট্রাম্পের ফেস ভ্যালু গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দ্রুতই একটি চুক্তি করতে পারেন যার মাধ্যমে ইউক্রেনকে যেকোনো সহযোগিতা বন্ধ করে দিতে পারেন। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, জেলেনস্কিকে বাদ রেখে তিনি পুতিনের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে পারেন। যেটির আলোকে পুতিনের দূরদর্শিতার কাছে ইউক্রেনের কিছু ভূ-খণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হারাবেন জেলেনস্কি। এভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি ঘটতে পারে। ভিনযামুরি বলেন, পুতিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু ছিল এবং থাকবে সেটির ওপর ভিত্তি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাশিয়ার ভূমিকা বাড়বে এবং সেটি হবে বহু মানুষের শঙ্কার বিষয়।
চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা
বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের দুই বৃহৎ সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক একটা প্রতিযোগিতা চলছে। বাণিজ্য, তাইওয়ান ইস্যু, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুদেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান। থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) মনে করে-ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে চীন ঘিরে ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি আবর্তিত হবে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র এসব ইস্যু দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি হবে না। ২০১৮ সালে চীন থেকে আমদানি পণ্যে ট্রাম্প প্রশাসন ২৫০ বিলিয়ন ডলার শুল্ক বসিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বাণিজ্য যুদ্ধ লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
এই তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ট্রাম্প চীনের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক শি জিনপিংয়ের সঙ্গে কাজ করার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। গত আগস্টে ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, শির সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু চীনের কিন্তু এখনও মনে রয়েছে, তার শুল্ক নীতির কারণে বেইজিংকে ওই সময় বড় অংকের মাসুল গুণতে হয়েছিল।
ট্রাম্প গর্বের সঙ্গে বলেছেন, কেউ চীন থেকে ব্যবসা করতে পারে না। আমি কিন্তু ঠিকই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বের করে নিয়ে এসেছি। ট্রাম্প বলেন, দেশের অর্থনীতি মজবুত করতে তিনি বিদেশি পণ্যে শুল্ক বাড়াবেন। সব ধরনের আমদানি পণ্যে তিনি ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। তবে শুধু চীনা পণ্যে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসাবেন। এতে অনুমেয় যুক্তরাষ্ট্রে চীনের ব্যবসায় খড়স আসছে।
ট্রাম্পের চীন নীতি নিয়ে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস থিংক ট্যাংকের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো জুশো কার্লজিকের মূল্যায়ন হচ্ছে—তিনি অনেক বেশি প্রত্যয়ী এবং অনেক বেশি আগ্রাসী। তাই সামনের দিনগুলোতে জিনপিংয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী হবে সেটি এখনই বলা মুশকিল।
নিঃশর্ত ম্যান্ডেট
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ১০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্যে ৯টিতে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যালেন লিকম্যান। তিনি ২০২৪ এর নির্বাচন নিয়ে বাজি ধরেছিলেন ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিসের পক্ষে। ভবিষ্যদ্বাণী করার ১৩ পদ্ধতির কথা উল্লেখ করে সিএনএনকে প্রফেসর লিকম্যান বলেছিলেন, কেন আমি নিশ্চিত যে হ্যারিস জিততে যাচ্ছেন? কারণ জরিপ শুধু সম্ভাবনার কথা বলে আর আমার পদ্ধতি জরিপ উপেক্ষা করে। তার এই পদ্ধতিতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের দলের ওপর চোখ রেখে ১৩টি সত্য-মিথ্যা বিবৃতির মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হয়।
যদি এগুলোর মধ্যে ছয়টি বা তারও বেশি বিবৃতি মিথ্যা হয়, তাহলে বিরোধীদলীয় প্রার্থী- এই ক্ষেত্রে ট্রাম্প- জয় পাবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। ভোটের আগে লিকম্যানের পদ্ধতি এখন দেখাচ্ছে ১৩টি বিবৃতি বা চাবির মধ্যে আটটি হ্যারিসের পক্ষে আর তিনটি তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে আছে। শুধু ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অধ্যাপক লিকম্যানের এই পদ্ধতি সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেনি।এবার সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটল। ট্রাম্প মিথ্যা প্রমাণ করলেন এই অধ্যাপকের ভবিষ্যতবাণী।
শুধু তাই নয়, আরেক জায়গায় ইতিহাসকে নিজের মতো করে লিখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম নির্বাচনে জয়, পরেরবার হার, এরপর তৃতীয় নির্বাচনে আবার জয়; মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সর্বশেষ এমন ‘কামব্যাক’ সম্পন্ন করেছিলেন গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড, ১৩২ বছর আগে। ১৮৮৫ থেকে ১৮৮৯ এবং ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। সেই ১৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙে ইতিহাস এবার ফিরিয়ে আনলেন ট্রাম্প।
২০১৬ সালে ইলেকটোরাল কলেজে জয় পেলেও পপুলার ভোটে হেরেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার ইলেকটোরাল-পপুলার উভয় ক্ষেত্রে এগিয়ে থেকেই জয় পেয়েছেন। বিবিসির খবর বলছে, ২৪ কোটি ৪০ লাখ ভোটারের মধ্যে এ পর্যন্ত ৭ কোটি ২৬ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৫ ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। আর প্রতিদ্বন্দ্বী হ্যারিস তার চেয়ে প্রায় অর্ধকোটি ভোট কম পেয়েছেন। তার ভোট সংখ্যা ৬ কোটি ৭৯ লাখ ৭৮ হাজার ৬৯৮ ভোট। বাকি চার রাজ্যের ফল ঘোষণা হলে ট্রাম্পের ভোট আর বাড়বে। ক্ষেত্রে তিনি বাইডেনের রেকর্ড ভাঙার সুযোগও পেয়ে যেতে পারেন। সর্বশেষ ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন আট কোটি ১২ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট। এর বিপরীতে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছিলেন সাত কোটি ৪২ লাখের বেশি ভোট।
নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জরিপে দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হলেও আগের দুই নির্বাচনের মতো লড়াই হয়নি এবার। ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর প্রথম থেকেই এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ সব জায়গায়ই ট্রাম্পের দলের জয়জয়কার।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল সিনেটে পেয়েছে ৫২ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে; ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছে ৪৪ আসন। নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্প ২০৬ আসন পেয়েছেন, আর হ্যারিস পেয়েছেন ১৯১ আসন। গভর্নরেও এগিয়ে রিপাবলিকানরা। ট্রাম্পের দল পেয়েছে ২৭ ও হ্যারিসের দল ২৩।
এতো বড় ম্যান্ডেট ট্রাম্পকে রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক বেশি ক্ষমতার ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে নি:সন্দেহে। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ নীতি বাস্তবায়নে তাকে মুখাপেক্ষী থাকা লাগবে না।