মেয়াদোত্তীর্ণের ৮ বছর পর অবশেষে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুন ২০২১, ১১:১৫:৫৬
শাবি প্রতিনিধি : মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় আট বছর পর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আলোচিত কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এই সময়ে শিক্ষক পেটানো, যৌননিপীড়ন, অভ্যন্তরীণ সংঘাতে প্রাণহানীসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে সদ্যবিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও থেমে থাকেনি অভিযোগ। বিভিন্ন সময় সংঘাত-সংঘর্ষ আর অস্ত্রের ঝনঝনানিতে দেশব্যাপী আলোচনায় ছিল শাবিপ্রবি ছাত্রলীগ।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ৮ মে সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থকে সভাপতি ও ইমরান খানকে সাধারণ সম্পাদক করে শাবিপ্রবি সাত সদস্যের কমিটির অনুমোদন দেন ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। মেয়াদোত্তীর্ণের দুবছর পর ২০১৬ সালের ৮ মে ১৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল ক্যাম্পাসে এক স্কুলছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন ও এর প্রতিবাদ করায় দুই সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় তৎকালীন সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থকে বহিষ্কার করে তিন মাস কমিটি স্থগিত রাখা হয়। পরে ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই সহ-সভাপতি মো. রুহুল আমিনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করে পুনরায় কমিটির অনুমোদন দেয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত আট বছরে ছয় থেকে সাত গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে সংগঠনটি। এ সময়ে শিক্ষক পেটানো, যৌননিপীড়ন, ভর্তি জালায়াতি, সাংবাদিককে মারধর, ফাও খেতে না দেওয়ায় রেস্টুরেন্ট ভাঙচুর, টেন্ডারবাজি, র্যাগিং, স্কুলছাত্রী ইভটিজিং ও মারধর এবং খাদিজার মতো কলেজছাত্রীকে কোপানোর মতো অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীরা।
সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে গত আট বছরে বেশ কয়েকবার বন্ধ ছিল ছাত্রদের আবাসিক হল। এ ছাড়া এ সময়ে একাধিকবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন। ক্যাম্পাস ও হলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত আট বছরে ছোট-বড় প্রায় দু শতাধিক সংঘর্ষে জড়িয়েছে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী।
২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সুমন দাস নামে বহিরাগত এক ছাত্রলীগকর্মী নিহত হন। বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র মহড়ায় ও গুলিতে প্রক্টরসহ অনন্ত ২০ জন আহত হন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় আড়াই মাস বন্ধ থাকায় সেশনজটে পড়ে শিক্ষার্থীরা।
২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর হামলা করে দেশব্যাপী আলোচনায় আসে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন। পরে বহিষ্কৃত তিনজনের মধ্যে দুজনকে কেন্দ্রীয় সদস্য পদে পদোন্নতি দেন তারা।
২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম কলেজছাত্রী খাদিজাকে কুপিয়ে হত্যা চেষ্টা করলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। এ ঘটনার পরও বদরুলের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তার সঙ্গে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। একই বছর চাঞ্চল্যকর ভর্তি জালিয়াতির সঙ্গে শাবি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নাম উঠে আসে।
২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল ক্যাম্পাসে বেড়াতে এলে এক স্কুলছাত্রীকে যৌনহয়রানি ও মারধর করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে দুই সাংবাদিককে মারধর করেন তারা।
২০১৮ সালের ২০ মার্চ ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনায় ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল রনি গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের ১২ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়।
২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি সরস্বতি পূজায় ক্যাম্পাসে মদ্যপান ও উদ্বৃত টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দুপক্ষে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একই বছর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ইমরান খানের ফাঁস হওয়া ফোনালাপে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজি এবং ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রুহুল আমিনকে উলঙ্গ করে ছবি তুলে ক্যাম্পাস থেকে বের করার পরিকল্পনা ফাঁস হয়।
২০২১ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসান স্বাধীনকে লিখিত সতর্কতা জানায় শাবিপ্রবি প্রশাসন।
এদিকে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছাত্রলীগের ৮ বছর মেয়াদি ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির ৮০ ভাগই ছিলেন অছাত্র। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ছাত্রত্ব শেষ হয় অনেক আগেই। বেশ কয়েক বছর যাবত ক্যাম্পাসে ছিলেন না কার্যনির্বাহী কমিটির তিন-চতুর্থাংশ সদস্য। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ সেশনের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. রুহল আমিনের স্নাতক ও স্নাকোত্তর সম্পন্ন হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোর্স সম্পন্ন না করায় ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ১৪৯তম একাডেমিক কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক ইমরান খানের ছাত্রত্ব বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া কমিটির ২১ সহ-সভাপতির ২০ জনই অছাত্র ও একজন অনিয়মিত শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে কেউ বিবাহিত, কেউ চাকরিজীবী বা কেউ বহিষ্কৃতদের তালিকায় ছিলেন। নয়জন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের মধ্য আটজন অছাত্র ও একজন অনিয়মিত শিক্ষার্থী। আবার তাদের কেউ বিবাহিত ও বহিষ্কৃত। ৯ সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে আটজন অছাত্র ও একজন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। ৪২ সম্পাদক ও উপ-সম্পাদকের মধ্যে ৩৬ জন অছাত্র ও ছয়জন চাকরিজীবী। ২৫ জন সহ-সম্পাদকের ১৯ জনই অছাত্র। ৩৫ কার্যনির্বাহী সদস্যের ১৬ জনই অছাত্র।