যুদ্ধের প্রথম ধাপ শেষ ঘোষণা মস্কোর
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ মার্চ ২০২২, ১:৩৪:০১
আকস্মিকভাবে রাশিয়ার সেনাপ্রধান সার্গেই রুডস্কয় গতকাল শুক্রবার ঘোষণা দিয়েছেন, ইউক্রেনে তাদের সামরিক অভিযানের প্রথম ধাপ শেষ হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশটি ইঙ্গিত দিচ্ছে ইউক্রেনে যুদ্ধের প্রত্যাশা সীমিত করেছে। পশ্চিমা কর্মকর্তাদের বিশ্বাস, এ ঘোষণা মস্কোর যুদ্ধ-পূর্ব কৌশলের ব্যর্থতার স্বীকৃতি। খবর বিবিসি ও নিউইয়র্ক টাইমস, আলজাজিরা ও দ্য গার্ডিয়ানের।
রাশিয়া আরও ঘোষণা করেছে, দেশটি এখন পূর্ব ইউক্রেনে আরও বেশি অঞ্চল দখলে মনোনিবেশ করবে। অর্থাৎ পূর্ব দোনবাস অঞ্চলে মস্কো তার প্রচেষ্টাকে কেন্দ্রীভূত করবে। সেখানে রাশিয়াপন্থি দুটি বিচ্ছিন্ন প্রজাতন্ত্র রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনে প্রবল প্রতিরোধের মুখে রাশিয়া বুঝতে পারছে যে দেশটির পুরোটা কিংবা বেশিরভাগ দখল করা মস্কোর পক্ষে আর সম্ভব নয়। রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় জেনারেল পরোক্ষভাবে এই স্বীকৃতিই দিলেন।
রাশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তার সামরিক হতাহতের বিষয়েও গতকাল নতুন পরিসংখ্যান দিয়েছে। এতে দাবি করা হয়েছে, যুদ্ধে ১,৩৫১ রুশ সেনা নিহত হয়েছে এবং ৩,৮২৫ জন আহত হয়েছে। তবে ইউক্রেনের অনুমান প্রায় ১৫ হাজার রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে।
এদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা এক মাস পার হলেও উল্লেখযোগ্য সফলতা আসেনি। রুশ বাহিনী এখন স্থল অভিযানের পরিবর্তে আকাশ ও সমুদ্রপথে হামলায় গুরুত্ব দিচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতি ও শুক্রবার কিয়েভ, চেরনিহিভ, খারকিভ, সুমি ও মারিউপোলে ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিমান হামলা চালিয়েছে রাশিয়ার সেনারা। এতে দেশটির প্রধান জ্বালানি ডিপো ধ্বংস হয়েছে বলে ক্রেমলিন দাবি করেছে। এদিকে কিয়েভের পূর্বাঞ্চলীয় শহরগুলো থেকে মস্কোর সেনাদের হটিয়ে ইউক্রেনের সেনারা সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। নিজেদের সেনাদের শক্তিতে প্রত্যয়ী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তারা বিজয়ের কাছাকাছি।
৩০ দিনের যুদ্ধে ইউক্রেনের খেরসন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো শহর দখলে নিতে পারেনি রুশ সেনারা। প্রধান বাণিজ্যিক বন্দরনগরী মারিউপোল, খারকিভসহ কয়েকটি শহর অবরুদ্ধ করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কিয়েভমুখী স্থল অভিযানও ৩০ কিলোমিটার দূরে আটকে দিয়েছে ইউক্রেনের সেনারা।
শুক্রবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগর কোনাশেনকভ বলেছেন, ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে বৃহত্তম জ্বালানি তেলের ডিপো ধ্বংস করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে কিয়েভ-সংলগ্ন গ্রাম ক্যালিনোভকায় অবস্থিত ডিপোয় ক্যালিব্রি হাই প্রিসিশন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ধ্বংস করা হয়েছে। এখান থেকেই সেনাবাহিনী ও ইউক্রেনের মধ্যাঞ্চলে জ্বালানি তেল সরবরাহ করত দেশটির সরকার।’
মস্কোর এ দাবি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে কিয়েভের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল সিএনএন। তারা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে দেশটির দিনিপ্রো অঞ্চলের জরুরি সেবা বিভাগ জানায়, শহরের সামরিক ইউনিটে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। এতে দুটি ভবনে আগুন ধরে যায় এবং পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। তবে সেখানে কতজন হতাহত হয়েছেন, তা জানা যায়নি। এদিন দক্ষিণাঞ্চলীয় মাইকোলাইভেও বিমান হামলা হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, এতে শহরের একটি বিদ্যালয় ও মেয়র কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চেরনিহিভের আঞ্চলিক গভর্নর ভিলেসলেভ চোয়াস বলেন, নগরীতে হামলা চালিয়ে একেবারে বিচ্ছিন্ন করেছে রুশ সেনারা। শত্রুরা শহরটি অবরুদ্ধ করে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ করছে। এ ছাড়া খারকিভে বিমান হামলায় চারজন ও সুমিতে দুই শিশু নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে খারকিভে মেডিকেল সেন্টারে বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রুশপন্থি বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত লুহানস্কে রাশিয়ার বিমান হামলায় অন্তত দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা এ পর্যন্ত ৪৬৭ ক্ষেপণাস্ত্রসহ ১৮০৪ বার বিমান হামলা চালিয়েছে। তবে রুশ বাহিনীকে স্থল অভিযানে ইউক্রেন শক্তভাবে প্রতিরোধ করছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে।
গতকাল ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাতে জানায়, ইউক্রেনের বাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় কিছু শহরের পুনর্নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রুশ বাহিনীকে পিছু হটাতে বাধ্য করেছে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, ‘ইউক্রেনীয়রা বিজয়ের কাছাকাছি যাচ্ছে। দেশকে অবশ্যই শান্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে, আমাদের প্রতিরোধে সেদিকে যাচ্ছে দেশ। আমরা এক মিনিটের জন্যও নীরব থাকতে পারি না।’ এরই মধ্যে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফে রুশ সেনাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশনা দিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘রুশ সেনারা! পাশে অস্ত্র রাখুন। হাত বা ফুল তুলে ধরুন। চিৎকার করে বলুন, আমি আত্মসমর্পণ করছি।’
গতকাল ইউক্রেন দাবি করেছে, রাশিয়ার ব্যবহার করা ৫৯ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ত্রুটিপূর্ণ। মস্কো এ পর্যন্ত ১২শ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। যার ৫৯ শতাংশ অবিস্ম্ফোরিত রয়েছে। তবে এ তথ্য নিরপেক্ষ সূত্রে যাচাই করতে পারেনি সংবাদমাধ্যমগুলো।
রাশিয়ার এ হামলায় এ পর্যন্ত এক হাজার ৩৫ জন বেসামরিক নিহত হয়েছেন বলে দাবি জাতিসংঘের। তাদের মধ্যে ১৩৫ শিশুও রয়েছে। ইউক্রেনে জাতিসংঘের মানবাধিকারকর্মীরা বলেছেন, মারিউপোলে গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাতে দুই শতাধিক মরদেহ রয়েছে। জাতিসংঘ আরও জানায়, রুশ নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলোতে গুমের ঘটনা ঘটছে। বেসামরিক ইউক্রেনীয়দের আটকের ৩৬টি ঘটনা যাচাই করেছে জাতিসংঘ।
এদিন ইউক্রেনের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, মারিউপোলের থিয়েটারে গত সপ্তাহের বোমা হামলায় সম্ভবত ৩০০ জন মারা গেছে। এ হামলার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করা হলেও তারা বোমা হামলা চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।
গতকাল ইউক্রেনের সেনাবাহিনী জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় একজন জেনারেলসহ দুইশ রুশ সেনা নিহত এবং ১২টি ট্যাঙ্ক ও দুটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করা হয়েছে। আর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কোনাশেনকভ জানান, গত এক মাসে ইউক্রেনের ২৬০টিরও অধিক ড্রোন, এক হাজার ৫৮০টিরও বেশি ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান ও ২০৪টি বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করছে রুশ বাহিনী।