মেসির কান্নাভেজা বিদায়ী কথামালা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ আগস্ট ২০২১, ৯:২৬:৫৩
‘শেষ কয়েকদিনে আমি অনেক ভেবেছি, ভেবেছি এখানে আমি কী বলতে পারি’ -বার্সেলোনায় বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে এসে এভাবেই শুরু করেন লিওনেল মেসি, ‘এবং, সত্যিটা হচ্ছে, কী বলব আমি তার কিছুই ভেবে উঠতে পারিনি, এটা আমার জন্য সত্যিই অনেক কঠিন একটা মুহূর্ত, এখানে এতগুলো বছর কাটানোর পর।’
আর্জেন্টাইন মহাতারকা মেসিকে আসছে মৌসুমে যে আর বার্সেলোনার জার্সিতে দেখা যাবে না সেটা ঘোষণা হয়ে গেছে কদিন আগেই। ক্লাব ও ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা খেলোয়াড়টিকে ন্যু ক্যাম্পে ধরে রাখতে না পারার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে কাতালানরা।
বার্সা সভাপতি জানিয়েছেন, বার্সা ও মেসির মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল, দুপক্ষ চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত ছিল, কিন্তু শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লা লিগার আর্থিক নিয়ম-কাঠামোর কারণে চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা সম্ভব হল না।
১৩ বছর বয়সে ন্যু ক্যাম্পে আসা মেসির ২১ বছরের বার্সা পথচলা তাতে শেষ হয়ে গেছে। বার্সার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি, রেকর্ড ৩৫ শিরোপা, রেকর্ড গোলদাতা, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৭৭৮ ম্যাচে ৬৭২ গোল করা খেলোয়াড়টিকে চলে যেতে হচ্ছে। এমনকি কোথায় যাচ্ছেন সেটি এখনও টিক হয়নি বলেই জানালেন ৩৪ বছরের মেসি।
‘আমি এখানে জীবনের পুরোটা সময় কাটিয়েছি, এ মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। গত বছর ব্যুরোফ্যাক্সের পর ঠিক করেছিলাম কী কী বলবো। কিন্তু এবছর, সবকিছুই অনেক অন্যরকম এখন।’
‘এবছর আমার পরিবার ও আমি ঠিক করেছিলাম, আমরা এখানেই থাকব। যেকোনো কিছুর থেকে এটাই আমরা সবচেয়ে বেশি চেয়েছিলাম। আমরা বাড়িতে ছিলাম, এবং ভেবেছিলাম আমরা এখানেই, বার্সেলোনাতেই থাকছি। এই শহর ও ফুটবল, এখানে সবকিছুই অসাধারণ।’
‘কিন্তু আজ, এই সবকিছুকেই আমাদের বিদায় বলতে হচ্ছে।’
‘সেই ১৩ বছর বয়স থেকে আমি এখানে। ২১ বছর পর চলে যাচ্ছি, স্ত্রী এবং তিন ছোট্ট কাতালান-আর্জেন্টাইন সন্তানকে নিয়ে। এবং, আমি সবকিছু বলে বোঝাতে পারব না আমার কেমন লাগছে।’
‘আপনাদের শুধু এটা এটা বলতে পারি, কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা এখানে ফিরে আসতে চাই, কারণ এটা আমার বাড়ি। আমি আমার সকল বর্তমান ও সাবেক সতীর্থের প্রতি কৃতজ্ঞ, প্রত্যেকের প্রতি, যারা আমার পাশে ছিলেন।’
‘এই ক্লাবটির জন্য আমার মাঝে গভীর শ্রদ্ধা বিরাজ করে। অনেক অসাধারণ মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছি এখানে। কিছু বাজে মুহূর্তও এসেছে। কিন্তু এসবকিছুই আমাকে বেড়ে উঠতে ও এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, এবং আমাকে সেই ব্যক্তিটি বানিয়েছে আজ আমি যা হতে পেরেছি।’
‘আমি ভিন্নভাবে বিদায় বলতে চেয়েছিলাম। কখনোই কল্পনা করিনি সবকিছু এভাবে ঘটবে। ভাবিনি আমাকে বিদায় বলতে হবে।’
‘গত বছর দর্শকছাড়া, দর্শকের উল্লাস-উৎসাহ ছাড়া মাঠে খেলেছি আমরা। জানি সময়টা কত কঠিন ছিল। আর এখন আমাকে দেড়বছর সেই দর্শকদের না দেখেই চলে যেতে হচ্ছে। মহামারির কারণে দর্শকদের চিৎকার ছাড়াই আমাকে খেলতে হয়েছে। এটা কঠিন ছিল, তাদের কাছে না দেখা, তাদের আমার নাম ধরে চিৎকার করতে না শোনা।’
‘আমি ধন্য, মানুষ যেভাবে আমার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এখানে অসাধারণ সব স্মৃতি আমি সঞ্চয় করেছি। আমি কল্পনা করছি, আবার এখানে ফিরে আসব। সকলের সামনে। ভিন্ন কোনো ভূমিকায়। কারণ এই ক্লাবটি বিশ্বের সেরা।’
কান্নাভেজা চোখে সংবাদ সম্মেলন কক্ষে ঢুকে এভাবেই নিজের মনের কথা তুলে ধরেন মেসি। মূহমূহ চোখ-নাকের জল মুছতে থাকেন। দেন অনেক প্রশ্নের উত্তর।
পিএসজি? প্রশ্নোত্তর পর্বে নতুন গন্তব্য নিয়ে বলতে হয় মেসিকে। জানান এখনও কোনো ক্লাবের সাথে সম্মত হননি। সবকিছুই আলোচনার মধ্যে আছে। পিএসজির নাম উঠে এলে ফরাসি ক্লাবে যাত্রাকে একটি সম্ভাবনা বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
‘পিএসজি একটি সম্ভাবনা। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কারও সাথেই চূড়ান্ত কোনো কিছুতে পৌঁছাইনি। যখন চুক্তি নবায়ন না হওয়ার ঘোষণা এলো, আমি অনেক ক্লাব থেকেই ফোন পেয়েছি। এখনও কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। তবে আলোচনা চলছে।’
ইবিজার ছবি নিয়ে: পিএসজির নেইমার, ডি মারিয়ার সঙ্গে ইবিজায় অবকাশ কাটানোর সময় তোলা একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন মেসি। সেটি নিয়েও বলতে হল, ‘সেখানে পিএসজি যাত্রার কোনো ইঙ্গিত নেই। আমরা নেইমারের বাসায় বারবিকিউয়ের জন্য যাচ্ছিলাম, ছবিটি সেই মুহূর্তে তোলা।’
‘সেসময় ওরা মজা করছিল, বলছিল আমার পিএসজিতে যাওয়া উচিত। এতটুকুই। সেই ছবিতে এর বেশি কিছু নেই। এটা শুধু বন্ধুদের সঙ্গে একটি সুন্দর মুহূর্তের ছবি। সেখানে রহস্যের কিছু নেই। কোনো ইঙ্গিত নেই।’
গত ৩০ জুন বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর ফ্রি-এজেন্ট হয়ে যান এলএম টেন। সেসময় দেশের জার্সিতে কোপা আমেরিকা খেলায় ব্যস্ত ছিলেন। আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম কোনো ট্রফি, মানে এবারের কোপা জিতে পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে বেড়িয়ে পড়েন।
মেসি একদিকে জলে-জঙ্গলে আনন্দঘন সময় কাটাচ্ছিলেন, অন্যদিকে ক্লাব ও সমর্থকদের উৎকণ্ঠা বাড়ছিল। ফ্রি-এজেন্ট মেসি যেকোনো সময় নাম লেখাতে পারতেন অন্য কোনো ক্লাবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আশার সলতে জ্বলছিল আঁতুড়ঘর ন্যু ক্যাম্প ছেড়ে অন্যকোথাও যাচ্ছেন না অধিনায়ক।
স্প্যানিশ গণমাধ্যমও কদিন পরপর জানান দিচ্ছিল, নতুন চুক্তির খুব কাছাকাছি আছেন মেসি ও বার্সা। বার্সেলোনায় আরও পাঁচ বছর থাকবেন, খবর এসেছিল ক্লাবের দুর্দশা বুঝে নতুন চুক্তিতে বসতে বেতনের ৫০ শতাংশ কমিয়ে নিতে রাজি হয়েছেন মেসি। কিন্তু বার্সার আর্থিক অবস্থার জটিলতার জেরে সেই চুক্তিও আগাল না।
কারণ, লা লিগার ঠিক করে দেয়া বেতনসীমার মধ্যে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেনি বার্সা। যেন এক জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে ক্লাবটি। দেনায় ডুবে আছে। এ অবস্থায় মেসির সঙ্গে নতুন চুক্তিতে বসলে বার্সাকে আরও জটিলতায় পড়তে হতো। ক্লাব থেকে তাড়াতে হতো অনেক খেলোয়াড়কে। সেজন্য বার্সার চেষ্টা অব্যাহত ছিল বলেও খবর হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। সব চেষ্টায় জল ঢালা হয়ে গেল মেসির বিদায়ের মধ্য দিয়ে।