কভিড-১৯ : বড় মুনাফার সুযোগ দেখছে ওষুধ জায়ান্টরা!
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ এপ্রিল ২০২০, ৩:৫৩:১৩
মার্চের প্রথম সপ্তাহে ইন্ডাস্ট্রি লবিস্টদের (নীতিনির্ধারক পর্যায়ে খাতভিত্তিক পেশাদার তদবিরকারী) সহায়তায় মার্কিন কংগ্রেসে উত্থাপিত একটি বিলের ভাষা বদলে দেয় দেশটিতে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। কভিড-১৯ নিয়ে ৮৩০ কোটি ডলারের জরুরি তহবিলসংক্রান্ত ওই বিলটি যেভাবে লেখা হয়েছিল, সিনেটে সেভাবে অনুমোদিত হলে বাজারে যেকোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধের মূল্য অন্যায্য বিবেচনায় তার মূল্য কমিয়ে পুনর্নির্ধারণের সুযোগ ছিল মার্কিন সরকারের।
ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্টরা সে সময় শুধু বিলের পেটেন্ট ও মূল্যসংক্রান্ত ধারাটি বদলেই ক্ষান্ত হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর তদবিরের জোরে বিলটিতে এমন এক নতুন ধারা যোগ হয়, যেটির কারণে ওয়াশিংটন চাইলেও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরের কোনো ওষুধের বাজারজাতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
বিষয়টি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের আইনপ্রণেতারা ব্যাপক শোরগোল তুলেও সুবিধা করে উঠতে পারেননি। মার্চের প্রথম দিককার ওই ঘটনা থেকেই ইঙ্গিত মেলে, বিশ্বব্যাপী মহামারীর মধ্যেও এর থেকে মুনাফা তুলে নেয়ার প্রয়াসে লিপ্ত হয়ে পড়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলো এবং এ নিয়ে তারা আটঘাট বেঁধেই নেমেছে।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি ফেডারেল তহবিলের মাধ্যমে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের ন্যায্যমূল্য ও সুলভে চিকিৎসা নিশ্চিত করার এক ব্যর্থ প্রয়াস নিয়েছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি জ্যান শাকোভস্কি। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় নীতিবিষয়ক মার্কিন গণমাধ্যম পলিটিকোয় দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এ বৈশ্বিক মহামারী পরিস্থিতিতেও ওষুধ কোম্পানিগুলোর নিজেদের খেয়ালখুশিমতো মূল্য নির্ধারণের স্বাধীনতা থাকবে, এ চিন্তাটাই অনৈতিক ও বিপজ্জনক।
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে রীতিমতো ধসিয়ে দিয়েছে। এমন কোনো খাত নেই, যা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু এ কভিড-১৯ ঝড়ের মধ্য দিয়েও বিশ্বব্যাপী একটি শিল্প বেশ ভালোভাবেই মুনাফা করে যাচ্ছে, সেটি হলো ওষুধ শিল্প।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো কভিড-১৯-কে দেখছে মুনাফার সবচেয়ে বড় সুযোগ হিসেবে। ‘ফার্মা: গ্রিড, লাইজ অ্যান্ড দ্য পয়জনিং অব আমেরিকা’ বইয়ের গ্রন্থকার জেরাল্ড পসনারের মতে, তারা সবাই (ওষুধ কোম্পানিগুলো) এখন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিক্রি ও মুনাফার দিক থেকে বৈশ্বিক এ সংকট শিল্পটির জন্য অনেক বড় সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে। মহামারী পরিস্থিতি যত খারাপ হবে, তাদের মুনাফাও তত বেশি হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক এ মহামারীর অন্ত ঘটানোর চাবিকাঠি ওষুধ কোম্পানিগুলোর হাতেই। বিশেষ করে বৈশ্বিক ওষুধ খাতের জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো; যাদের গবেষণা সুবিধা অন্যদের তুলনায় বেশি উন্নত।
বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। চিকিৎসকরাও ভাইরাসের প্রভাবজনিত অসুস্থতা প্রশমন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে কভিড-১৯-এর ওষুধের প্রতীক্ষায় অধীর অপেক্ষা করছে গোটা বিশ্ব। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতের লড়াইটা আদতে এখন সময়ের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন মনোযোগ বেশি এমন ওষুধের দিকে, যেগুলো একসঙ্গে দ্রুত অনেক বেশি পরিমাণে উৎপাদন করা সম্ভব এবং অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত।
এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী এখন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর মধ্যে চার ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতিকে চিহ্নিত করেছে, যা কভিড-১৯-এর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে এইচআইভির সমন্বিত চিকিৎসা ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক চিকিৎসাও রয়েছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়নি, ইবোলা নিরাময়ের জন্য উদ্ভাবিত নতুন এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যেও সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছে ডব্লিউএইচও। কিন্তু এগুলো নিয়ে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, যার ফল পেতে সময় লাগবে। ফলে নতুন কোনো কার্যকর পদ্ধতি খুঁজে বের করা এখন অপরিহার্য।
ওষুধ ও ভাইরাস সম্পর্কে প্রচুর তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয়গুলোকে খুঁজে বের করে তার কার্যকর প্রয়োগ নির্ধারণের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রয়োগ অপরিহার্য। পৃথিবীব্যাপী বড় এআই কোম্পানিগুলোও এখন এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
কিন্তু এ গোটা কার্যপ্রক্রিয়ার প্রয়োগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো। এ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের হাতে থাকা সম্ভাবনাময় চিকিৎসা তথ্য অন্যদের দিতে চাইছে না। বাণিজ্যিক গোপনীয়তার অজুহাত তুলে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের হাতে থাকা যাবতীয় তথ্য কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সংরক্ষণ করছে।
অথচ শুধু তথ্য আদান-প্রদানকে কাজে লাগিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের জিনোম ম্যাপিং করতে সক্ষম হয়েছেন গবেষকরা। এ মুহূর্তে কভিড-১৯-কে পরাস্ত করতে হলে ওষুধ কোম্পানিগুলোর তাদের নিজস্ব বাণিজ্যিক স্বার্থের বাইরে এসে এ নিয়ে একযোগে কাজ করার মানসিকতা দেখাতে হবে। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যে সাবেক লেবার সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশনের পরিচালক ও শল্যবিদ প্রফেসর আরা দারজি এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোকে এখন তাদের নিজ নিজ বাণিজ্যিক উচ্চাভিলাষকে ত্যাগ করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য যৌথ প্রয়াসের ভিত্তিতে চিকিৎসা পদ্ধতি শনাক্তকরণ, পরীক্ষণ, উন্নয়ন ও উৎপাদনের দিকে এগিয়ে আসতে হবে।
এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাস পরিবারভুক্ত ভাইরাসগুলো নিয়ে গবেষণায় সবচেয়ে এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ। ২০০৩ সালে সার্স মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এ-সংক্রান্ত গবেষণায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এর পরও এ প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরাও এখনো সময়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছেন।
সার্স মহামারীর সময়ে এর ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মহামারী থেমে যাওয়ার পর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা না থাকায় সেটি এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে ইয়েল স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক জ্যাসন শোয়ার্টজ সম্প্রতি মার্কিন এক গণমাধ্যমকে বলেন, যদি আমরা সার্সের ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা বন্ধ করে না দিতাম, তাহলে আমাদের অনেক মৌলিক তথ্য হাতে থাকত। কাজও অনেকদূর এগোনো থাকত, যা সার্সের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এ ভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেত।
সার্সের ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক মডেলে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম পুরোপুরি মুনাফাভিত্তিক। মহামারীর সংকট থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ভ্যাকসিনের বাজারও তখন আর থাকে না। ফলে ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণার তহবিলও ফুরিয়ে যায়, থেমে যায় গবেষণাও।
সম্প্রতি মার্কিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (এনআইএআইডি) কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করে। মর্ডার্না নামে একটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত গবেষণার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনটি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এটি ব্যাপক হারে উৎপাদনে আসতে সময় নেবে কমপক্ষে এক বছর। এক্ষেত্রেও ফাইজার, নোভার্টিসের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো একটিকে সঙ্গে নিয়ে এ প্রক্রিয়ায় যেতে হবে এনআইএআইডিকে। কারণ প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মজুদের পাশাপাশি ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রক্রিয়াও নিজেদের নামে পেটেন্ট করে রেখেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। মার্কিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী (সেক্রেটারি ফর হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস) অ্যালেক্স অ্যাজারও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের মূল্য নিয়ন্ত্রণকারী পদক্ষেপ না নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। মুনাফার সম্ভাব্যতা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ও কতদূর এগিয়ে আসতে পারে, এ মুহূর্তে সেটিই বড় এক প্রশ্ন।
সূত্র: দ্য পলিটিকো, ইন্টারসেপ্ট, গার্ডিয়ান ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য গণমাধ্যম।