তারেক রহমানের দেশে ফেরার সম্ভাবনা
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩০:০৫
ড: মোর্শেদ হাসান খান :
স্বৈরাচারের পতনের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে মানুষের মাঝে আকাক্সক্ষার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মতো আমার মনেও তার দেশে ফেরা নিয়ে আশার সঞ্চার করে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের উপস্থিতি অতীব জরুরি। এর সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে আলাপ চলে আসে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার কুক্ষিগত বিচার বিভাগ তারেক রহমানের সাথে যে বৈষম্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে অবিচার করেছে তার প্রতিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
৫ আগস্ট অভ্যুত্থান-পরবর্তী আমারা রাষ্ট্রের সংস্কারে মনোযোগী। পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে রাষ্ট্র, সরকার, আওয়ামী লীগ এবং ব্যক্তি হাসিনা মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। ব্যক্তি হাসিনার খেয়ালেই সবকিছু পরিচালিত হতো। ফলে রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে পড়েছিল এবং রাষ্ট্র একটি মাফিয়া গোষ্ঠীর ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিল। আমূল সংস্কার ব্যতীত এর থেকে পরিত্রাণের বিকল্প নেই এবং আমরা আশাবাদী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের সঙ্কল্প নিয়ে। আমাদের সবার মনে থাকার কথা, ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই তারেক রহমান রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফার রূপরেখা ঘোষণা করেন এবং একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত জাতীয় সরকারের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। আমারা সবাই এখন কি তা চাই না? এখনে বিবেচ্য অন্তর্বর্তী সরকারের বাস্তবায়িত সংস্কার বনাম নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার কোনটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও টেকসই হবে। বিগত সরকারের আমলই প্রমাণ করে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে প্রতিষ্ঠিত আইন, সংবিধান এবং প্রচলিত রীতির অকাল মৃত্যু ঘটে। সুতরাং তারেক রহমানকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি বিবেচনায় রাষ্ট্র সংস্কারে এখন থেকেই তার অংশগ্রহণকে আমি সমর্থন করি।
জাতিকে এই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ করতে পরে এমন নেতা বাংলাদেশে বেশি নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ। তারপরও হাসপাতাল থেকে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে একতা এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তার ভাষণের ভ‚মিকা অপরিসীম। বেগম খালেদা জিয়ার পরে এমন নেতা যার আহ্বানে জাতি সাড়া দেবে তেমন একজনই আছেন এবং তিনি তারেক রহমান। বাংলাদেশের এখন সর্ববৃহৎ জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। এই ব্যাপক এবং বিস্তৃত দলকে পরিচালনায় শক্ত এবং গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব প্রয়োজন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে এখন এর শূন্যতা রয়েছে এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরার মাধ্যমে রয়েছে তার সমাধান। শত ষড়যন্ত্র এবং আক্রমণ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অক্ষত এবং অটুট থেকেছে সুদূর লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নেতৃত্বে। আমাদের মধ্যে তার উপস্থিতি এই নেতৃত্ব আরো দৃঢ় এবং ফলপ্রসূ করবে।
বর্তমানে একটি বিতর্ক দেখা দিয়েছে, এমনকি খোদ বিএনপিতে এ নিয়ে মতভেদ আছে, তা হলো- তারেক রহমান কোন প্রক্রিয়ায় দেশে ফিরবেন। তারেক রহমান আমাদের ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতা। অন্তর্বর্তী সরকারের অনুকম্পায় দেশে ফেরা তার ভাবমর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক। বাকি থাকে রাজনৈতিক আন্দোলন অথবা আইনি মোকবেলার মাধ্যমে তার দেশে ফেরার রাস্তা সুগম করা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন জনগণ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করার সম্ভাবনা প্রবল। বিগত ১৫ বছরের দুঃশাসন থেকে বের হয়ে বিপর্যস্ত জাতিকে পুনরুদ্ধার এখন জনসাধারণের অগ্রাধিকার। এসব বিবেচনায় তারেক রহমানের আইনি প্রক্রিয়ায় তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এবং রায়কৃত মামলাগুলো মোকাবেলা করার মাধ্যমে ফেরাই উত্তম। এ পদ্ধতিতে ইতোমধ্যে নির্যাতিত নেতা মাহমুদুর রহমান এবং শফিক রেহমান পথ দেখিয়েছেন।
তদন্ত ও বিচার বিভাগকে ন্যক্কারজনকভাবে প্রভাবিত এবং দলীয়করণের মাধ্যমে তারেক রহমানকে কিভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে এবং অবশেষে আদালত থেকে রায় বের করা হয়েছে তা বোঝার জন্য আমারা দু’টি মামলার কিছু বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কিত এবং আতঙ্কজনক ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় প্রথম অভিযোগপত্র ওয়ান-ইলেভেন সরকার ২০০৮ সালে আদালতে পেশ করে এবং বিচারকাজ শুরু করে। যে ওয়ান-ইলেভেন সরকার সত্য-মিথ্যা সব অজুহাতে তারেক রহমানের সম্মানহানিতে সক্রিয় ছিল, তারাও এ মামলায় তারেক রহমানকে জড়ানোর কোনো তথ্য প্রমাণ আদালতে দাখিল করতে পারেনি। নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিয়মবহিভর্‚তভাবে অবসর থেকে ফিরিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পর বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দকে ওই মামলায় অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং প্রধান আসামিদের মধ্যে অন্যতম মুফতি হান্নানকে ৪০০ দিন রিমান্ডে অকথ্য নির্যাতন শেষে তারেক রহমানকে জড়িয়ে জবানবন্দী আদায়ের মাধ্যমে মামলার পঞ্চম অভিযোগপত্রে তারেক রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর বিচারের নামে যা হয়েছে তা হলো প্রহসন। মুফতি হান্নান নিজে আদালতে তারেক রহমানকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন করলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। এমনকি তারেক রহমানের আইনজীবী মুফতি হান্নানকে জেরা করার সুযোগ পাননি। অন্য কোনো সাক্ষী তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়নি। আর মুফতি হান্নানকে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলার মামলার রায়ে তড়িঘড়ি করে ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে তার কাছ থেকে সত্য উদঘাটনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দের দলীয় আনুগত্য নিয়ে জনমনে এখন আর কোনো দ্বিধা নেই। আর পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অনুগত পুলিশ কর্মকর্তারা কেমন দানব হয় তার উদাহরণ বেনজীর, হারুন আর বিপ্লবরা আমাদের সামনে জাজ্বল্যমান। ২০০১ এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনে নিজ এলাকাতে কাজ করা এবং ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়নে ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা কাহহার আকন্দ এখন যথারীতি পলাতক।
বিএনপির আমলে জজ মিয়া নাটকের অভিযোগ আর আওয়ামী লীগের আমলে সঠিক তদন্ত বয়ানকারীরা কিছু সত্য চেপে যান। বিএনপি আমলে কোনো অভিযোগপত্র দেয়া হয়নি এবং তাদের সময়ই প্রথম মুফতি হান্নার গ্রেফতার হন। বিএনপির সময়ে মামলাটি তদন্তাধীন ছিল। অপর দিকে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্তে বাধা দেয়া এবং আলামত নষ্ট করার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আছে। তার চেয়ও ভয়ঙ্কর অভিযোগ আছে স্বয়ং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। শেষ মুহূর্তে সমাবেশের স্থান পরিবর্তনের কারণ এখনো অজানা।
গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর গণমাধ্যমে বিচারক মোতাহার হেসেনের একটি বক্তব্য প্রচার পেয়েছে। তার বক্তব্য থেকে তারেক রহমানকে দোষী করে রায় দেয়ার জন্য ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার যে ভয়ঙ্কর চাপ প্রয়োগ করেছিল তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এরপরও নিজের বিবেক এবং বিচারক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে তার দায়িত্ব পালনের ফলে আওয়ামী অত্যাচারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এই বিচারকের মতে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা সেই মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুযায়ী সাজা দেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজা দিতেই লিখিত রায়ে স্বাক্ষর করার চাপও ছিল মোতাহার হোসেনের ওপর। বিচারিক আদালতে বেকসুর খালাস লাভের পরও হাইকোর্ট তারেক রহমানকে সাত বছরের করাদণ্ড দেন, অথচ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ বা তথ্য আদালতে সরকার প্রমাণ করতে পারেনি।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেন সরকার যে বিস্তর দুর্নীতি এবং চাঁদাবাজির ঢালাও অভিযোগ এনেছিল তার কিছুই প্রমাণ করা যায়নি; বরং এখন বের হয়ে আসছে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি এবং চাপ প্রয়োগ করে ওয়ান-ইলেভেন সরকার এবং আওয়ামী পৃষ্ঠপোষকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করতে বাধ্য করেছে। আর আছে ‘অনুভ‚তিতে আঘাতপ্রাপ্ত’ কিছু দলীয় ব্যক্তির দায়ের করা মামলা। আর সরকারের দায়ের করা কিছু ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলা। এখনো দেখা যায়, অনেক মানুষের মনে তারেক রহমানকে নিয়ে সন্দেহ ও দ্বিধা। আমার অনুরোধ হলো- অমূলক সন্দেহের বশে উপসংহার না টেনে ব্যক্তি তারেক রহমান এবং তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হওয়া এবং তার যোগ্য মর্যাদা দেয়া। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দানা বাঁধার বছরখানেক আগে থেকেই তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচন, জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্র সংস্কারের নিরলস দাবি জানিয়ে আসছেন। কোনো রাজনৈতিক নেতার থেকে এমন আহ্বান বাংলাদেশে অভূতপূর্ব। সসম্মানে তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোতে আমি আশাবাদী।
লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়