জলবায়ু পরিবর্তন: অভিযোজন তহবিলের জন্য বৈশ্বিক সমর্থন কামনা প্রধানমন্ত্রীর
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৩৭:৩৭
জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য অভিযোজন তহবিল বৃদ্ধি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জি-২০এর কাছ থেকে জোরালো সমর্থন কামনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৃহত্তর সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সামাল দিতে শক্তিশালী ও গ্রিন মেকানিজম এবং আপহোল্ড সাসটেইনেবিলিটিসহ তিনটি অগ্রাধিকার ইস্যুও উপস্থাপন করেন।
এফ২০ ক্লাইমেট সলিউশন উইক উপলক্ষে মঙ্গলবার উচ্চ পর্যায়ের ভার্চুয়াল সভায় মূল বক্তব্য প্রদানকালে এই সমর্থন কামনা করে প্রধানমন্ত্রী ইস্যুগুলো উপস্থাপন করেন। সোমবার এই সপ্তাহ শুরু হয়েছে। এফ২০ এবং কিং খালেদ ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এই সপ্তাহের আয়োজন করেছে।
তিনি বলেন, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য অভিযোজন তহবিল বৃদ্ধি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জি-২০-এর কাছ থেকে জোরালো সমর্থন কামনা করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, বাস্তুচ্যুত অথবা জলবায়ু শরণার্থী ইস্যুতে বৈশ্বিক সমর্থন যোগাতে জি২০কে বৃহত্তর দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত নিরীহ মানুষকে কিভাবে সামাল দিতে পারবো তা ব্যাপকভাবে নির্ভর করছে সকলের শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের কারণে প্রকৃতি ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশের চেয়ে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে কেউ ভাল জানে না।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিনটি বিষয় উল্লেখ করেন।
প্রথমত, ২০৩০ সালের এজেন্ডা সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করাটা হচ্ছে মৌলিক বিষয়, কারণ উভয়ের একে অপরের সঙ্গে সিবিওটিক বা মিথোজীবী সম্পর্ক আছে;
দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী এবং সবুজায়ন কৌশল গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আমাদের বৃহত্তর সহযোগিতা প্রয়োজন। জি-২০ দেশগুলোর এখানে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
এবং তৃতীয়ত, দায়িত্ব ভাগাভাগি এবং অংশীদারিত্ব বোধ থেকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বৈশ্বিক অর্থায়ন ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন করতে হবে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ) এবং স্বল্পোন্নত দেশসমূহ তহবিল (এলডিসিএফ) এর মতো বৈশ্বিক অর্থায়ন তহবিলে মারাত্মক সম্পদ ঘাটতি অত্যন্ত দুঃখজনক।
তিনি বলেন, জলবায়ু এবং টেকসই পরিবেশ দুটি বিষয় পারস্পরিক নির্ভরশীল এবং বিশ্ব পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ, বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ, বিশ্বের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ এবং বিশ্বের মোট আয়তনের প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে জি-২০ অর্থনীতিভুক্ত।
সুতরাং, বৈশ্বিক জলবায়ু এবং টেকসই পরিবেশের যে কোন ভাল ফলাফলের জন্য জি-২০ এর মধ্য দিয়ে যেতে হবে। জি-২০ এর আগে দেখিয়েছে যৌথভাবে তারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের সুবিধার জন্য অনেক উপকারী পদক্ষেপ নিতে পারে।
জলবায়ূ পরিবর্তনকে আন্তঃসীমান্ত বিরূপ প্রভাবসম্বলিত একটি বৈশ্বিক সমস্যা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কর্মকান্ড বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব।
তিনি বলেন, টেকসই পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কোন জায়গায় টেকসই পরিবেশ ভঙ্গুর হলে সব জায়গার টেকসই পুরোপুরি বিঘ্নিত হবে। জলবায়ু পরিবর্তন চূড়ান্ত অস্তিত্বের জন্যই হুমকি এবং এর পরিণতি নিকট ও দূর ভবিষ্যতে আরো খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সূচনাই হয়েছে মানব কর্মকান্ডের ফলে টেকসই পরিবেশ নষ্ট করার জন্য। এর ফলে, মানুষ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যা, বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, ভূমিধস এবং খরার সম্মুখীন হচ্ছে।
তিনি বলেন, সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এমনকি অর্ধেক মিটারও জলবায়ুর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের জন্য হুমকি হতে পারে। তিনি বলেন, এ কারণে একটি উচ্চাভিলাষী সম্মিলিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ এ সময়ের জন্য খুবই জরুরি এবং জি-২০ এর সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া আমাদের শিশু ও ভবিষ্যতকে সুরক্ষা দেয়া যাবে না।
আর এ কারণেই, প্যারিস চুক্তি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন কঠিন। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে অর্থনীতিতে উন্নত দেশগুলির কাছ থেকে তাদের উৎপাদন ও ভোগের পুনঃনির্ধারণ করতে সহযোগিতা ও সমর্থন কামনা করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অবশ্যই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখতে হবে এবং প্রধান কার্বন নি:সরণকারী দেশ হিসেবে জি ২০ দেশগুলোকে তাদের এনডিসি (ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস) পুনরায় সাজানো উচিত।
তিনি বলেন, বদ্বীপ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সর্বদাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এখানকার লোকেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে স্মরণাতীত কাল থেকে তাদের সহনশীল সক্ষমতার মাধ্যমে টিকে আছে।
বাংলাদেশ এখন অভিযোজন বিষয়ে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক অফিসের আয়োজক হিসেবে একটি বৈশ্বিক কেন্দ্র যা অভিযোজন কার্যক্রম জোরদার করবে। তিনি জি ২০ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ বর্তমানে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম-সিভিএফ’র সভাপতি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন প্রশমন ও অভিযোজন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলবায়ুজনিত বিপর্যয় মোকাবেলায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে প্রণীত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গঠিত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলে সরকার নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে প্রতিবছর সারাদেশে লাখ লাখ গাছের চারা রোপন করা হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে কেবল এই বছরেই সরকার ১ কোটি চারা রোপন করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা লবনাক্ততা, বন্যা এবং খরা সহিষ্ণু শস্যের এবং কৃষি প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। আমরা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছি, জাতির পিতা ৪৫ বছর আগে এটি প্রথম সূচনা করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অভিযোজন কার্যক্রমের জন্য ২০১০ সালের পর থেকে সরকার প্রতিবছর গড়ে ২০০ কোটি ডলার ব্যয় করছে, যা জিডিপির ১ শতাংশ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সংসদে সম্প্রতি “প্ল্যানেটারি ইমার্জেন্সি” শিরোনামে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, এতে সকল দেশের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হিসাবে ঘোষণার জন্য অন্য সকল সংসদকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
জার্মান অর্থমন্ত্রী ও ভাইস চ্যান্সেলর ওলাফ স্কলস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. আবদুল্লাহ বেলহাইফ আল নুয়াইমি, কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস, এফ ২০ এর সহ সভাপতি,কিং খালিদ ফাউন্ডেশন প্রিন্সেস বেসমাহ বিনতে বদোর, এফ২০ এর সভাপতি ক্লাউস মিলকে এবং জার্মান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড সদস্য ড. সাবিনি মাউডারার অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন।