পানিতে দাঁড়িয়েই ইদের নামাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০২০, ৬:০৬:০১
ভয়াল ২৫ মে আজ। এ দিনেই ২০০৯ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়। আইলায় খুলনার উপকূলীয় কয়রার বাঁধ ভেসে যায়। কিন্তু ১১ বছরেও তা নির্মিত হয়নি। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে সব। এখন কয়রার মানুষ নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ তৈরি করছেন। আইলার আঘাতের সেই দিবসেই এবার পবিত্র ইদুল ফিতর পালিত হচ্ছে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের ওপর পানির মধ্যে দাঁড়িয়েই কয়রাবাসী ইদের নামাজ আদায় করেছেন। নামাজ শেষে তারা আবার বাঁধ মেরামতের কাজে নেমে পড়েন।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়েই নামাজ শেষে সেমাই খেয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ তৈরি উৎসবে নামেন। দুপুরে তাদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে খিচুড়ির। এভাবেই ইদের দিন বাঁধ মেরামতের উৎসব পালন করছেন আইলা ও আম্পানে ক্ষতবিক্ষত হওয়া কয়রার মানুষ।
২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতে কয়রার পাউবোর বেড়িবাঁধের ২৭টি পয়েন্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে লোনা পানিতে তলিয়ে যায়। ২০ মে আম্ফানের আঘাতে কয়রার বেড়িবাঁধের ২৪ পয়েন্ট ভেঙে আবারও লোনা পানিতে সয়লাব হয়।
আইলায় আঘাতের পর দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা, খাসিটানা, জোড়শিং, মাটিয়াভাঙা উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরি, গাববুনিয়া, গাজিপাড়া, কাটকাটা, কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬নং কয়রা, ৪নং কয়রার পুরাতন লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, ঘাটাখালি, হরিণখোলা, মহারাজপুর ইউনিয়নের উত্তর মঠবাড়ি, দশালিয়া, লোকা, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কালিবাড়ি, নয়ানি, শেখেরটেক এলাকার বেড়িবাঁধ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
গত ১১ বছর ধরে কয়রার মানুষ এসব বেড়িবাঁধ সংস্কার করার আন্দোলন করে। আইলার ৩ বছর পর ২০১২ সালে পবনা বাঁধ, হারেজখালি, পদ্মপুকুর, শিকারিবাড়ি, পাথরখালি বাঁধ মেরামত করা হয়। কিন্তু তারপর থেকে কয়রার ৬টি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৬০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত মাটি পড়েনি।
পাউবো সূত্র অনুযায়ী, আইলার পর ‘উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প ফেজ-১’ এর আওতায় খুলনাসহ উপকূলীয় ৬২৫ কিলোমিটার বাঁধ পুনঃনির্মাণে বৃহৎ প্রকল্প ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনার দাকোপে ৩১ নং পোল্ডার এবং বটিয়াঘাটায় ৩০ ও ৩৪/২ পোল্ডারে বাঁধ পুনঃসংস্কার কাজ করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও এ অঞ্চলের বেড়িবাঁধ নিয়ে মানুষের আতঙ্ক কমেনি।
২০১৯ সালের ৪ মে ঘূর্ণিঝড় ফনী ও ১১ নভেম্বর বুলবুলের সময় উপকূলীয় কয়রা ও দাকোপে বড় আতঙ্ক ছিল বেড়িবাঁধ। আর গত ২০ মে আম্পানের সময় এ আতঙ্ক প্রবল হয়ে ওঠে। আম্পানের আঘাতে কয়রার বাঁধ ধ্বসে যায়। সমগ্র কয়রা এখন লোনা পানির বদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছে।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, কয়রার মানুষ বাঁধ মেরামত না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না। কারণ বাঁধ আটকাতে না পারলে লোনা পানির মধ্যে বসবাস করা কঠিন হবে। কয়রার মানুষ এখন ত্রাণ চায় না, বাঁধ চায়।
তাই সবাই মিলে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করলেও তাদের পেটে দানা পানি প্রয়োজন। উপজেলা প্রশাসন সেটুকুর জোগান দিয়ে লোনাপানিতে বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে উৎসাহ দিচ্ছেন।
কয়রা উপজেলার ৩নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আব্দুল গফ্ফার ঢালি বলেন, বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনীহার কারণেই আজ কয়রার মানুষকে লোনা পানিতে ডুবতে হল। জোড়াতালির কাজ কোনও কাজেই আসেনি। কিন্তু অর্থের অপচয় হয়েছে।
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রাবাসীর বেড়িবাঁধ নিয়ে আন্দোলন ২৫ মে থেকে নতুন মাত্রায় যুক্ত হবে। এখন পর্যন্ত টেকসই বাঁধ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব কিছু ঠিকাদার দিয়ে করা কাজের মান ছিল নিম্মমানের। ফলে আম্ফানের আঘাতে সেসব স্থানই আগে ভেঙেছে আর এলাকা লোনা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এখানে ভালো ফসল হয়, মাছ চাষ হয়। এখন কয়রার মানুষ বাঁধ চায়। ত্রাণের দরকার হবে না।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহ বলেন, আইলা বিধ্বস্ত কয়রা এখন আম্ফানে বিধ্বস্ত হয়ে আরও মুখ থুবড়ে পড়েছে। কয়রার ৪টি ইউনিয়রে সমগ্র এলাকা লোনা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। কয়রার মানুষ এখন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা ইদের দিন বাঁধের ওপরই নামাজ আদায় করে সেমাই খেয়ে মেরামতে নেমে পড়েছেন। দুপুরে তাদের জন্য খিচুড়ির আয়োজন রয়েছে।