বিশ্ব বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছিলো রানীগঞ্জের গণহত্যা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ১:০৬:১০
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার রানীগঞ্জ বাজার। মহান স্বাধীনতার সময়কালে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী এই বাজার ছিলো নৌ বন্দর। এখানেই আশেপাশের গ্রামের লোক বাজার করতে ভিড় করতেন। আসতেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেপারিরাও। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার উত্তাল সময়েও রাণীগঞ্জ বাজারে মানুষের ভিড় থাকতো। হাঁকডাকে সরগরম থাকতো এই বাজার।
আর এই বাজারেই ১৯৭১ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পুরো বাজার। আর এই গণহত্যার খবর বিবিসিতে প্রকাশিত হলে নড়ে উঠে বিশ্ব বিবেক।
এদিকে বাজারের নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের কথা স্মরণ করলে এখনও আঁতকে উঠেন স্থানীয়রা। থমকে যায় মুখের ভাষা, অবশ হয়ে পড়ে শরীর। অথচ সেই গণহত্যার জায়গায় তৈরি স্মৃতিসৌধ পড়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়।
আর স্থানীয়রা পুরনো স্মৃতিসৌধ ভেঙে নতুন করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন। যাতে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারে। জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনী বর্বরতার কথা।
জানা যায়, ১৯৭১ সালে পহেলা সেপ্টেম্বর রানীগঞ্জের সকল ব্যবসায়ী, বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্রেতা, নৌকার মাঝিসহ সবাইকে স্থানীয় রাজাকার এহিয়া ও রাজ্জাককে দিয়ে খবর পাঠানো হয় বাজারের রাজ্জাক মিয়ার দোকানে আসতে।
এসময় কেউ কেউ ভয়ে পালালেও নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রক্ষা এবং ঝামেলা এড়ানোর জন্য শতাধিক মানুষ তাদের কথামতো উপস্থিত হন। সকলে জড়ো হবার পর কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয় শতাধিক মানুষকে।
পরে এদের নিয়ে যাওয়া হয় পাশের কুশিয়ারা নদীর তীরে। সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পেছন দিক থেকে গুলি করে রক্তে রঞ্জিত করে দেয় কুশিয়ারা নদী। প্রথম গুলিতে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়ায় একাধিকবার লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়। পরে এসব শহীদদের মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
এজন্য হত্যাকাণ্ডে শতাধিক মানুষ শহীদ হলেও ৩৪ জনের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অনেক চেষ্টা করেও অন্যদের পরিচয় বের করা যায়নি।
১৯৮৭ সালে তৎকালীন জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু খালেদ চৌধুরীর প্রচেষ্টায় ৩৪ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছয় জন আহতের নাম লিপিবদ্ধ করে স্মৃতিসৌধে নির্মিত হয়। তবে স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হলেও নারকীয় হত্যার এই জায়গায় তৈরি হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ।
স্থানীয়রা জানান, নতুন করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানালেও কোনো কাজ হচ্ছে না। আর ২০১০ সালে জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ মুক্তার প্রস্তাবে শিরামিসি ও রানীগঞ্জ গণহত্যার স্মৃতিসৌধে প্রশাসনিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এরপর থেকে রানীগঞ্জ গণহত্যার দিবসে প্রশাসনের শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্যোগে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ কর্মসূচি পালন করা হয়।
রানীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সামাদ বলেন, রানীগঞ্জ বাজারে যে গণহত্যা হয়েছিলো সেটি বিশ্ব বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছিল। আর স্থানীয়রা এখনো গণহত্যার কথা মনে করলে আঁতকে উঠেন।
তিনি আরও বলেন, এখানে তৈরি স্মৃতিসৌধটি অনেক পুরনো। সেজন্য আমরা নতুন স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছি। আর আমাদেরকে এটি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। এতে আমাদের প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে।
জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহেদী হাসান বলেন, রানীগঞ্জ গণহত্যার স্থানে স্মৃতিসৌধ আছে। তবে আমরা নতুন করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছি।