এনসিপির সমাবেশ ঘিরে রণক্ষেত্র
গোপালগঞ্জে গুলিতে যুবলীগ কর্মীসহ নিহত ৪, শহর জুড়ে কারফিউ জারি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৯:৩৬
স্টাফ রিপোর্টার : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে গোপালগঞ্জ শহরে হামলা-সংঘর্ষে এ পর্যন্ত চার জন নিহত এবং সাংবাদিক-পুলিশসহ প্রায় শতাধিক আহতের খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে বুধবার দুপুরে গোপালগঞ্জ পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সভার আগে এনসিপির সমাবেশস্থলে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সমর্থক স্থানীয় ২/৩শ’ জনগণ লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। হামলাকারীরা এসময় মঞ্চের চেয়ার ভাঙচুর ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। এসময় পুলিশের গাড়িতে আগুন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটে।
এদিকে, হামলা, ভাঙচুর ও বাধাদানের পরও গোপালগঞ্জে ‘মুজিববাদ-মুর্দাবাদ’ স্লোগানে সমাবেশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। মঞ্চে উঠেই এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ ‘মুজিববাদ-মুর্দাবাদ, ইনকিলাব-জিন্দাবাদ’ স্লোগান ধরেন। এসময় দলটির নেতারা গোপালগঞ্জে মুজিববাদের কবর রচনারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সমাবেশে বক্তব্য দেন এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ প্রমুখ।
এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা যুদ্ধের আহ্বান নিয়ে গোপালগঞ্জে আসিনি, গোপালগঞ্জের নামও বদলাতে আসিনি, আমরা শান্তি ও দেশ গড়ার আহ্বান নিয়ে এসেছি। নতুন বাংলাদেশে গোপালগঞ্জের মানুষের অধিকার যাতে রক্ষা করা যায়, সেই প্রতিশ্রুতি দিতে এসেছি।
আমাদের সমাবেশে আজ যারা হামলা করেছে, বাধা দিয়েছে, আমরা দ্বিগুণ গতিতে তাদের এর জবাব দেবো, বলেন তিনি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, গোপালগঞ্জবাসী যারা এই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে রয়েছেন, নতুন বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছেন, আপনাদের দায়িত্ব নিতে হবে, গোপালগঞ্জ যেন মুজিববাদীদের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠতে না পারে। যদি পুলিশ-প্রশাসন ব্যর্থ হয়, নিজেদের রক্ষার দায়িত্ব, নিজেদের জেলার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব, এমনকি বাংলাদেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে।
দুপুর আড়াইটার পরে সভা শেষে এনসিপি নেতারা গাড়িতে উঠে সমাবেশস্থল ত্যাগ করার সময় গাড়িবহরে আবারও হামলা হয়। এ সময় গাড়িবহর লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও গাড়ি ভাঙচুর শুরু হলে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। হামলাকারীরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করেও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় জনতা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আইনশৃংখলা বাহিনী সংঘর্ষ থামাতে মুহুর্মুহু রাবার বুলেট ও টিয়ারসেল ছুঁড়ে। মুহুর্তের মধ্যে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় অত্র এলাকা। সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ । ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় জনতা জেলা কারাগারেও হামলা করে। তারা কারাগারের প্রধান ফটক ভাঙ্গার চেষ্টা করে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রতিহত করেন। এ সময় এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। পরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে এনসিপির নেতাকর্মীদের একত্রিত করে সেনা পাহারায় বাগেরহাটের প্রবেশদ্বার মোল্লারহাট সেতু পার করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। পরিস্থিতি সামলাতে বিকেলে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় ৪ প্লাটুন বিজিবি।
স্থানীয়রা জানান, হামলাকারী ও পুলিশের মধ্যে প্রায় ৩ ঘন্টা পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। এতে বাজার এলাকা থেকে পাচুড়িয়া পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়ক রণক্ষেত্র পরিণত হয়। নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী হামলাকারীদের উপর গুলি চালায়। এতে যুবলীগ সদস্যসহ নিহত চার জন হলো- জেলা শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে যুবলীগ সদস্য দীপ্ত সাহা (২৫), শহরের থানাপাড়ার কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (২৪), সদর উপজেলার আড়পাড়া এলাকার আজাদ তালুকদারের ছেলে ইমন তালুকদার (১৮) এবং টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ইদ্রিস মোল্লার ছেলে সোহেল মোল্লা (৩৫)। এরা সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে বলে গোপালগঞ্জ আড়াই’শ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ডা. শেখ মো. নাবিল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেছেন, গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য জেলা জুড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পরবর্তিতে রাত ৮টা থেকে পরের দিন আজ বৃহস্পতিবার ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। এসব ঘটনায় জেলা শহরসহ আশপাশ এলাকায় ভিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এদিকে, সংঘর্ষে পুলিশ-সাংবাদিকসহ শতাধিক লোকজন আহতের খবর পাওয়া গেছে। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার মোহাম্মদপাড়া এলাকার সুমন বিশ্বাসকে (২০) গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত সুমনের মা নিপা বিশ্বাস বলেন, দুপুরে জানতে পারি ছেলের শরীরে গুলি লেগেছে। তাকে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ছেলেকে দেখতে সেখানে যাই। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকায় নিয়ে আসি।
আহত সুমন জানান, তিনি সদর উপজেলার পাচুরিয়া এলাকার এনএসআই কোয়ার্টারের পেছনে একটি পানি সরবরাহকারী কোম্পানিতে কাজ করেন। দুপুরে এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হলে তিনি কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। কিন্তু সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান এবং একটি গুলি তার পেটের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে সামনের দিকে বেরিয়ে যায়। সেই সঙ্গে তার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপরই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
ঢামেক জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, তার পেটের সামনে ও পাশে দুটি গুলির ক্ষত রয়েছে এবং ডান হাতের একটি আঙুলও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।