সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড
দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, নানা প্রশ্ন!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৪:০৪
নিহত ফায়ার ফাইটার নয়নের কর্মস্থল বিশ্বনাথে
মিরর ডেস্ক : মধ্যরাতে আগুন লাগল সচিবালয়ে, তা নেভাতে লাগল ১০ ঘণ্টা। আগুন নেভাতে গিয়ে সড়কে ট্রাকচাপায় নিহত হলেন ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন (২৪)। ফায়ার সার্ভিসের ৬১তম ব্যাচের এই সদস্যের মূল কর্মস্থল ছিল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশন। সম্প্রতি তাকে ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত করা হয়েছিল।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোররাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে। ঢাকায় ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের কয়েক’শ গজ দূরেই সচিবালয়।
রাত ২টার দিকে আগুন লাগার খবর পেয়েই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছুটে যান সচিবালয়ে। তাদের সহায়তা করতে যোগ দেয় পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা।
১০ ঘণ্টা পর বেলা পৌনে ১২টার দিকে আগুন পুরোপুরি নেভানো হয় বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়। আগুন নেভাতে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট। তার আগে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণের খবর দিয়েছিল এই বাহিনী।
এদিকে, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু, কেপিআই স্থাপনা সচিবালয়ে এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনে ষড়যন্ত্রের সন্দেহ করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা, যিনি জুলাই অভ্যুত্থানেরও নেতা। তার সন্দেহ ধরে নাশকতার আলোচনা চলছে সোশাল মিডিয়ায়।
এই অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, সেই বিষযে ফাযার সার্ভিসের কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে চাননি। ক্ষযক্ষতির তথ্যও তাৎক্ষণিকভাবে মেলেনি।
আগুন লাগার কারণ খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিটি করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাত সদস্যের এই কমিটির নেতৃত্বে দেবেন।
# ৭ নম্বর ভবনে আছে কী?
ঢাকার রমনায় কয়েকটি ভবন নিয়ে সচিবালয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) হিসাবে এটি বিশেষ নিরাপত্তা পায়।
সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে।
এর বাইরে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ছয়টি বিভাগের কার্যালয়ও সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে। এগুলো হলো সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
# আগুন লেগেছিল কোথায়?
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল সকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ৭ নম্বর ভবনের ৬, ৭, ৮, ৯ এই চারটি তলায় আগুন লেগেছে। তারা সেখানে নেভানোর কাজ করছেন।
“রাত ১টা ৫২ মিনিটে আমরা মেসেজ পাই যে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লেগেছে। ১টা ৫৪ মিনিটের মধ্যে আমাদের ইউনিট পৌঁছে যায়।”
তবে, ভবনের বাইরে থেকে ৬ থেকে ৮ তলায়ই আগুনের চিহ্ন বেশি দেখা গেছে।
# নেভাতে কেন দেরি?
আগুন নেভানোর কাজে অন্তরায়ের কথাও বলেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জাহেদ কামাল।
তার ভাষ্যে, সচিবালয়ের ফটক দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো ঢুকতে না পারায় কাজ করতে বেগ পেতে হয়েছিল তাদের। সেই কারণে সামনের ফটক ভাঙতে হয়েছিল তাদের।
সচিবালয়ে ঢোকার মোট পাঁচটি ফটক রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার ফটক আছে দুটি। তবে সেই দুটি দিয়েও বড় বাড়ি ঢোকানো যাচ্ছিল না। ৪ নম্বর ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলেন, আগুন নেভানোর জন্য দুটি টার্নটেবল ল্যাডার (টিটিএল) ভেতরে ঢোকাতে পেরেছিলেন তারা। আরও বেশি টিটিএল ঢোকাতে পারলে আগুন আরও আগে নেভানো যেত।
তারা আরও বলেন, মন্ত্রণালয়গুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছিল। তাতে ব্যবহার হচ্ছে কাঠের। সেই কারণে আগুন ছড়িয়েছিল। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কক্ষ বন্ধ ছিল বলে তালা ভেঙে, জানালা ভেঙে তাদের ঢুকতে হয়।
# ষড়যন্ত্র?
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই নানা ষড়যন্ত্র চলার কথা বলছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে অন্য উপদেষ্টাদের মুখ থেকেও এমন ষড়যন্ত্রের কথা শোনা গেছে।
সচিবালয়ে আগুন লাগার খবর শুনেই তেমন ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সরকারে দায়িত্ব পাওয়া আসিফ মাহমুদ স্থানীয় সরকার ও যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার পদ সামলাচ্ছেন, তার দুটি দপ্তরই ৭ নম্বর ভবনে।
আসিফ রংপুর অঞ্চল সফরে ছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে নীলফামারীতে অবস্থান করছিলেন তিনি। আগুন লাগার খবর পেয়েই তিনি ঢাকায় রওনা হন।
তবে তার আগে ফেইসবুকে এক পোস্টে তিনি লেখেন, “স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থ লোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল।
“আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এখনও জানা যায়নি। আমাদেরকে ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আসিফ মাহমুদের সঙ্গে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনকারী সারজিস আলমও ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন।
এখন জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা সারজিস ফেইসবুকে লিখেছেন, “বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের যারা চাটার দল ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম স্টেকহোল্ডার ছিল আমলাদের বৃহৎ একটা অংশ। এদের উপর ভর দিয়েই হাসিনা এই দেশে তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল।
“যখনই বিপ্লবীরা হাসিনার অপকর্ম, চুরি, লুটপাট, দুর্নীতির দিকে নজর দিয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে, তখনই সচিবালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার দালালেরা বিভিন্ন অপকর্মের ফাইলগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দিল।”
ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের শেকড় উপড়ে ফেলতে তার সহযোদ্ধা থেকে এখন উপদেষ্টার পদে থাকা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের প্রতি আহŸান জানান তিনি।
# ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড তদন্তে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসন ও শৃঙ্খলা শাখা থেকে জারি করা এক অফিস আদেশে এই তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে একজন সদস্য-সচিব এবং পাঁচজন সদস্য রাখা হয়েছে।
সদস্য হিসাবে থাকছেন- জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রতিনিধি।
গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে অফিস আদেশে বলা হয়েছে, সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ উদ্ঘাটন; অগ্নি দুর্ঘটনার পেছনে কারও ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায়দায়িত্ব আছে কি না তা উদ্ঘাটন এবং এ জাতীয় দুর্ঘটনা প্রতিরোধকল্পে সুপারিশ প্রেরণ।
# ফায়ার ফাইটারের মৃত্যু
আগুন লাগার খবর পেয়েই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছুটে গিয়েছিল সচিবালয়ে। তখন রাস্তা পার হতে গিয়ে বাহিনীর একজন কর্মীর মৃত্যু ঘটে।
নিহত সোয়ানুর জামান নয়ন (২৪) ফায়ার ফাইটার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের ৬১তম ব্যাচের এই সদস্যের মূল কর্মস্থল ছিল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশন। সম্প্রতি তাকে ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত করা হয়েছিল।
ফায়ার ফাইটার নয়নের মৃত্যুর খবর দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। একটা পাইপ নিয়ে সচিবালয়ের দিকে আসছিলেন, রাস্তা পার হচ্ছিলেন, এ সময় একটা ট্রাক তাকে ধাক্কা দেয়।”
নয়নকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনায় আরও দুই-তিনজন সামান্য আহত হন বলেও জানান উপদেষ্টা।