হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার, কী বলে ইসলাম?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:৪৯:২৩
* শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বিন মহসিন *
ইসলাম এক সামগ্রিক ধর্ম। এর অর্থ প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান আছে। হয়তো কুরআনে থাকবে, নয়তো হাদিসে, অথবা কুরআন-হাদিসের মূলনীতির আলোকে বাস্তবতার নিরিখে সেটির সমাধান বের করতে হবে। এটিকেই ফিকহ বলা হয়। বিজ্ঞানে যেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য সেটিকে কুরআন-হাদিসের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যায় না। কারণ, কুরআন-হাদিস ও বিজ্ঞান একটি আরেকটির প্রতিপক্ষ নয়। বরং একটি আরেকটির সহায়ক। আল কুরআনে বিবেক বুদ্ধি ও কমনসেন্স ব্যবহার করতে বারবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘তারা কি বোঝে না? তারা কি চিন্তাভাবনা করে না? এতে নিদর্শন আছে বুদ্ধিমানদের জন্য, আকলমন্দদের জন্য, যাদের ভেতর বিবেক আছে তাদের জন্য এতে এভিডেন্স আছে, উলুল আলবাব, উলুন নুহা, আফালা ইয়াকিলুন, তারা কি ভাবে না? পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করে না? হে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা, উপদেশ গ্রহণ কর।’ ইত্যাদি বিভিন্নভাবে অসংখ্য আয়াতে আল কুরআনে বুদ্ধি ও মেধা ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। বুদ্ধির ব্যবহার থেকেই বিজ্ঞান। পবিত্র কুরআনই পৃথিবীতে বিজ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত করেছে। এখন আসি জেন্ডার বিষয়ে। নারী ও পুরুষ এই দুটিতেই কি সীমাবদ্ধ? থার্ড জেন্ডার বা ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান কী?
প্রথমেই আমরা পবিত্র কুরআন খুলে দেখি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর এই যে, তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী, শুক্রবিন্দু হতে, যখন তা স্খলিত হয়। [সুরা নাজম, আয়াত: ৪৬, ৪৭]
অন্যত্র মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, হে মানব, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন, তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন… [সুরা নিসা, আয়াত: ১]
অন্য আরেক স্থানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আকাশ ও পৃথিবীর আধিপত্য আল্লাহরই, তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন অথবা দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা করে দেন বন্ধ্যা। তিনি সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান। [সুরা শুরা, আয়াত: ৪৯, ৫০]
এই শেষ আয়াতের ব্যাখ্যায় হিজরি ষষ্ঠ শতকের স্পেনের বিখ্যাত তাফসিরকার কাজি আবু বকর ইবনুল আরাবি রহ. তার তাফসির গ্রন্থে বলেন, এই আয়াতের আলোকে কেউ কেউ তৃতীয় লিঙ্গকে অস্বীকার করে, তাদের যুক্তি হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষ এই দুই ভাগে জেন্ডার ভাগ করেছেন, হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ করেননি। তৃতীয় লিঙ্গ বলে কিছু থাকলে আল্লাহ অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। ইবনে আরাবি বলেন, আমরা বলব, তাদের এ কথা সম্পূর্ণ অজ্ঞতাপ্রসূত, ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার কারণেই তারা এমন কথা বলেছে। আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও কুদরত সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা নেই।
ইবনুল আরাবি আরও বলেন, আল্লাহর ক্ষমতা অসীম এবং তিনি মহাজ্ঞানী। আল কুরআন হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গকে অস্বীকার করেনি। কারণ আল্লাহ বলেছেন, আসমান-জমিনের সমস্ত সৃষ্টি তারই, তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। [সুরা শুরা, আয়াত: ৪৯] নারী, পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গ সবকিছুই এ আয়াতের আওতাভুক্ত। যেসব আয়াতে নারী-পুরুষ দুভাগে ভাগ করা হয়েছে সেখানে তৃতীয় লিঙ্গকে অস্বীকার করা উদ্দেশ্য নয়, বরং ভাগটা করা হয়েছে অধিকাংশ বিবেচনায়। সাধারণত নারী ও পুরুষ দুই জেন্ডার মানব সমাজে পাওয়া যায়। তৃতীয় লিঙ্গের উপস্থিতি সামান্য ও বিরল। বিরল হওয়ার কারণে আল্লাহ পৃথকভাবে উল্লেখ করেননি, কিন্তু আয়াতের প্রথম অংশে এর উল্লেখ হয়ে গেছে। আল্লাহ যা ইচ্ছা তা সৃষ্টি করেন, আয়াতের এ অংশে স্পষ্টভাবেই সব ধরনের জেন্ডারকে আল্লাহ স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাস্তবতা এর সাক্ষী দেয় এবং যারা কুরআনের দোহাই দিয়ে হিজড়াদের অস্বীকার করতে চায় বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদের মিথ্যা প্রমাণ করে। [তাফসিরে কুরতুবি]
এবার অন্য একটি সুরা দেখুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, শপথ রাতের যখন তা আচ্ছন্ন করে, শপথ দিনের যখন তা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, এবং শপথ নর ও নারীর যা তিনি সৃষ্টি করেছেন। [সুরা লাইল, আয়াত: ১-৩] এই আয়াতগুলোর পরেই মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, প্রথম ভাগ যারা জান্নাতে যাবে, দ্বিতীয় ভাগ যারা জাহান্নামে যাবে। কুরআনে দুই ভাগই উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসে তৃতীয় আরেক প্রকারের উল্লেখ আছে, যারা কিছু কাল জাহান্নামে থেকে তারপর জান্নাতে যাবে। একইভাবে রাত-দিন দুভাগে ভাগ হলেও অনেক সময় রাত-না দিন তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। সকালের আগে-পরে এবং সন্ধ্যার আগে-পরে মেঘ বা কুয়াশায় অনেক সময় প্রকৃতি আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, সেটা দিন-না রাত তা বোঝা যায় না। জেন্ডারের ক্ষেত্রেও এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। নারী-পুরুষের মাঝামাঝি একটা অবস্থা আছে, পুরুষও নয়, নারীও নয়, অথবা নারী-পুরুষ উভয়ের সংমিশ্রণ; কোনো এক দিক চূড়ান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত সেটিকে তৃতীয় লিঙ্গ বলা হয়।
কুরআনে না থাকলেও ইসলামি ফিকহে হানাফি মালেকি শাফেয়ি হাম্বলি সালাফি ও শিয়া–প্রতিটি স্কুল অব থটেই তাদের নিয়ে আলাদা অধ্যায় আছে। ইসলামের প্রথম যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত মুসলিম স্কলাররা তাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। হিজড়া সংক্রান্ত মাসআলা বর্ণনা করেছেন। কাজেই এখন এ বিষয় নিয়ে অস্পষ্টতা থাকতে পারে না। কুরআনের মৌলিক একটি বিধান হচ্ছে দুর্বলের প্রতি সদয়তা ও সহমর্মিতা। এই মূল নীতির আলোকেই তাদের প্রতি সহানুভূতির শিক্ষা আমরা পাই। অতি সম্প্রতি ঢাকা শহরে হিজড়াদের একটি মাদ্রাসাও হয়েছে। শরিফ শরিফার গল্প নিয়ে যে বিতর্ক চলছে এসব বিতর্ককে বড় না করে আমাদের প্রয়োজন হিজড়াদের অধিকার সংরক্ষণে সচেষ্ট হওয়া। তাদের আলাদা সংঘ নয় বরং সামাজিক স্বীকৃতি এবং ছেলে ও মেয়ের মতো স্বাভাবিকভাবেই যেন তারা সমাজে বেড়ে উঠতে পারে এবং আত্মসম্মান নিয়ে চলতে পারে, সেদিকে মনোযোগী হওয়া।
ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কেও বিস্তর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। যেটা ইসলামবিরুদ্ধ সেটা তো মুসলিম হিসেবে আমরা মেনে নিতে পারি না। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে যেসব ছেলে-মেয়ে রূপান্তরকামী বা এক জেন্ডার হয়ে অন্য জেন্ডারের হরমোন বয়ে বেড়াচ্ছে বা মানসিকভাবে নিজেদেরকে ভিন্ন জেন্ডার মনে করছে তাদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। এ বিষয়টিকেও নিষিদ্ধ গন্দম না বানিয়ে এ সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা হওয়া জরুরি। আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে অনেক নতুন নতুন বিষয় আমাদের সামনে আসবে। কুরআন-হাদিসের দিকনির্দেশনা সম্পর্কেও আমরা সম্যক অবহিত হতে পারব। উত্তেজনা না ছড়িয়ে মূল বিষয়ের সঠিক জ্ঞান আহরণই আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।