যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি খালা-ভাগনে খুনের রহস্য এখনো অন্ধকারে
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুন ২০২১, ৭:২৯:৪১
মেরি জামান এবং শিশু মোহাম্মদ তায়েফের মাথাবিহীন লাশ উদ্ধারের পর ওলমেস্টেড কাউন্টি পুলিশ পরিচয় শনাক্ত করতে হিমশিম খায়।
১৯৯৯ সালের ২৬ নভেম্বর নিউইয়র্কের রচেস্টার শহরে রাস্তার পাশে একটি ব্যাগে মাথাবিহীন দুটি লাশ পেয়েছিলেন এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। একজন ৩০ বছর বয়সী নারী। আরেকটি দেহ ৪ বছর বয়সী শিশুর। দুজনই বাংলাদেশি, সম্পর্কে খালা-ভাগ্নে। ওই ঘটনার পর ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যাকাণ্ডের ‘আসল উদ্দেশ্য’ এখনো জানা যায়নি। খোঁজ মেলেনি শিশুটির মায়েরও!
দুই দশকের পুরোনো এই ঘটনার কথা দেশ রূপান্তর জানতে পেরেছে চার্লি প্রজেক্ট নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে। সংস্থাটি নিখোঁজ মানুষদের তথ্য সংরক্ষণ করে তাদের সন্ধান চালিয়ে থাকে। সংস্থাটি থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আরেকটি প্রতিবেদন করেছিলেন এই প্রতিবেদক: ২৭ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে অপহরণ হওয়া মেয়েটি কি বাংলাদেশে?
খালা-ভাগনের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল: খুন হওয়া নারীর নাম মেরি জামান। শিশুটির নাম মোহাম্মদ তায়েফ। তায়েফ তার মা সোফিয়া জামানের সঙ্গে খালা মেরির বাসায় যুক্তরাষ্ট্রে থাকতো। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের ধারণা, মেরির স্বামী ইকবাল আহমেদ দুজনকে খুন করেন। কিন্তু সোফিয়ার ভাগ্যে কী ঘটেছে সেটি এখনো অজানা।
মেরি এবং তায়েফের মাথাবিহীন লাশ উদ্ধারের পর ওলমেস্টেড কাউন্টি পুলিশ দুজনের পরিচয় শনাক্ত করতে হিমশিম খায়। পুলিশ এতটাই অন্ধকারে ছিল যে মেরি-তায়েফকে মা-ছেলে ধারণা করে কবর দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কবরস্থানে এভাবেই তাদের পরিচয় লেখা আছে!
গোয়েন্দা উপন্যাসের মতো অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পুলিশ জানতে পারে তারা আসলে খালা-ভাগনে। কিন্তু তত দিনে ইকবাল বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এরপর ইকবালকে ধরতে পুরো ঘটনা চেপে পায় পুলিশ। কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, ইকবাল ঠিকই একদিন নিউইয়র্কে ফিরবেন। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধী বিনিময় চুক্তি না থাকায় এভাবে অপেক্ষা করেন মার্কিন গোয়েন্দারা।
যেভাবে পাওয়া যায় ইকবালের খবর: ওলমেস্টেড কাউন্টি পুলিশের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ মামলার বিবরণে লিখেছে, মেরির বাঁহাতের মধ্যমায় সোনার আংটি ছিল। মৃত্যুর আগে শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন তিনি। তার বাঁহাতের আঙুলগুলোতে নেলপালিশ লাগানো ছিল। কিন্তু ডানহাতের একটিতেও ছিল না। পুলিশের ধারণা, নেলপালিশ লাগানোর সময় মেরিকে পেছন থেকে আঘাত করে খুনি। শিশু তায়েফের দেহ ছিল টি-শার্টে মোড়ানো।
লাশ দুটির মাথা না থাকায় দাঁতের তথ্য পাচ্ছিল না পুলিশ। যা তাদের তদন্ত বেশ জটিল করে তোলে। পরে ওই অঞ্চলের স্কুলের রেকর্ড খোঁজা হয়। সেখান থেকে আসিফ আহমেদ নামের আরেকটি শিশুর নাম পাওয়া যায়, যে কিছুদিন আগে স্কুল বদল করেছে।
গেজ এলিমেন্টারি স্কুলে পড়তো আসিফ। তায়েফ এবং মেরির লাশ উদ্ধারের কয়েক সপ্তাহ আগে আসিফকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেন তার মা-বাবা। আসিফের পরিবার ঠিক কোথায় গেছে, সেই সন্ধানে নামেন গোয়েন্দারা। বাড়ির নম্বরে ফোন করলে বন্ধ পাওয়া যায়।
স্কুল থেকে আসিফের বাবা-মায়ের কর্মক্ষেত্রের ফোন নম্বর জোগাড় করে সেখানে খোঁজ নেন গোয়েন্দারা। ইন্ডিয়ান গার্ডেন নামের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন আসিফের মা-বাবা। রেস্টুরেন্টটির মালিক জানান, আসিফের বাবার নাম ইকবাল আহমেদ। মা মেরি জামান। দুজনই তার রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন। কিন্তু কয়েক দিন আগে কাজ ছেড়ে চলে গেছেন।
রেস্টুরেন্টের এক ম্যানেজার বলেন, ইকাবল তার স্ত্রীর সঙ্গে একদিন মারামারি করেন। তারপরই দুজন কাজ ছেড়ে চলে যান। এই তথ্য পেয়ে পুলিশ নড়েচড়ে বসে। এবার ইকবালের ব্যাংকের তথ্য জোগাড় করা হয়।
গোয়েন্দারা জানতে পারেন, খুনের কয়েক সপ্তাহ আগে ইকবাল কুঠার জাতীয় ভারী একটি অস্ত্র কেনেন। সঙ্গে বড় ব্যাগ। ওই সময় নিজের জন্য এবং বাচ্চা আসিফের জন্য নিউইয়র্ক টু বাংলাদেশের দুটি টিকিটও কেনেন।
পুলিশ তখন তথ্যগুলো হাতে নিয়ে ইকবালের অপেক্ষায় থাকে, কবে সে নিউইয়র্কে ফেরে।
ঘটনার বাকি ছিল আরও: ২০০০ সালের ডিসেম্বরে নিউ ইয়র্কের বিমানবন্দরে মোহাম্মদ তারেক নামের এক বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে মার্কিন গোয়েন্দারা। তারেক জানান, স্ত্রী এবং ছেলেকে খুঁজতে তিনি নিউইয়র্কে গেছেন।
তারেকের দেয়া ঠিকানা থেকে পুলিশ তখন হিসাব মেলাতে থাকে। এই তারেক মূলত মেরির বোন সোফিয়ার স্বামী। অর্থাৎ তায়েফের বাবা।
মেরি এবং তায়েফ যেদিন খুন হয়, সেদিন থেকে সোফিয়াও নিখোঁজ।
ওই ডিসেম্বরেই দিল্লি ভিত্তিক এক এফবিআই এজেন্ট বাংলাদেশে ইকবালকে শনাক্ত করেন। ওই এজেন্ট কৌশলে ইকবালের ছেলে আসিফের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে বুঝতে পারেন ছেলেটি বেঁচে আছে। আসিফ সেই ছেলে, যাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন ইকবাল।
ওই এজেন্ট নিশ্চিত হন, মেরি জামান মূলত আসিফের মা। আর তায়েফ সোফিয়া-তারেকের ছেলে।
পুলিশ তাদের নথিতে লিখেছে, ‘হিংসা, সন্দেহ থেকে মেরি হত্যার শিকার হয়ে থাকতে পারেন। মেরির সঙ্গে অন্য কারো সম্পর্ক ছিল কি না, কিংবা ইকবালের সঙ্গে অন্য কারো সম্পর্ক ছিল না; হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই প্রশ্নের যোগসূত্র থাকতে পারে। কিন্তু উত্তর পাওয়ার উপায় নেই।’
২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, অভিযুক্ত ইকবাল বাংলাদেশের কারাগারে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ২০০৫ সালের দিকে অন্য দুটি খুনের মামলায় বাংলাদেশে তার সাজা হয়।
সোফিয়ার কী হল: সোফিয়ার স্বামী মোহাম্মদ তারেক বাংলাদেশে বসবাস করেন। কয়েক বছর আগে পোস্ট বুলেটিন নামের একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে ইমেইলের মাধ্যমে তিনি জানান, কাউন্টি পুলিশের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। স্ত্রী সোফিয়া বেঁচে আছেন বলে ধারণা তার।
রচেস্টারের সব মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের কারণেই আমার ছেলের খুনি সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি। আমার প্রিয় সন্তান আপনাদের শহরে চিরনিদ্রায়। রচেস্টারের সব মানুষকে আমার ভালোবাসা।’