‘বয়কট তুরস্কে’ সৌদিতে উধাও তুর্কি পণ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ নভেম্বর ২০২০, ৪:৫০:৪১
মুসলিম বিশ্বের দুই প্রধান শক্তি সৌদি আরব ও তুরস্কের মধ্যে রাজনৈতিক রেষারেষি ধাক্কা দিয়েছে বাণিজ্যিক সম্পর্কেও। অঘোষিতভাবে তুরস্কের পণ্য বয়কট করছে সৌদি সরকার। ফলে আরব দেশটির মার্কেট থেকে উধাও হয়ে গেছে তুর্কি পণ্য।
বিবিসি জানায়, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান সরকারকে শায়েস্তা করতে বাজার বন্ধের কৌশল নিয়েছে সৌদি আরব।
আরব দেশটিতে তুর্কি পণ্যর বয়কট ক্যাম্পেইন ছড়িয়ে পড়েছে। সৌদি দোকান ও চেইন সুপার শপগুলোতে টাঙানো হয়েছে ব্যানার, যাতে তুর্কি পণ্য বয়কটের আহ্বান করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ প্রচারণা ছড়িয়ে পড়েছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে সৌদি সরকার বলছে যে, তুরস্ক থেকে পণ্য আমদানির ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।
তবে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক এবং তুরস্কের ব্যবসায়ী মহলের মতে, তুর্কি পণ্য বয়কটের যে ক্যাম্পেইন দ্রুত সৌদি আরবে ছড়িয়ে পড়েছে তার পেছনে রয়েছে দেশটির সরকার।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত না হলেও সৌদি আরব তুরস্কের পণ্য আমদানির ওপর ‘অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা‘ চাপিয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।
সৌদি সরকারের ইচ্ছাতেই যে এই বয়কট ক্যাম্পেইন চলছে, তার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় গত সপ্তাহে। তখন সৌদি খাদ্য এবং ওষুধ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ (এসএফডিএ) তুরস্ক থেকে সব ধরনের মাংস, মাছ, ডিম এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আমদানি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত জানায়।
তুর্কি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেও সৌদি কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্তের কথা নিশ্চিত করেছে।
জানা যায়, প্রকাশ্যে এই ‘তুর্কি বয়কট’ ক্যাম্পেইনের নেতৃত্ব দিচ্ছে সৌদি আরবের শীর্ষ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সমিতি- রিয়াদ চেম্বার অব কমার্স।
সমিতিটি এক বিবৃতিতে স্পষ্ট করে যে, তুরস্কে কোনও বিনিয়োগ নয়, তুরস্ক থেকে কোনও আমদানি নয় এবং তুরস্কে কোনও পর্যটন নয়।
রিয়াদ থেকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, সৌদি চেইন সুপারমার্কেটগুলো একে একে তুর্কি পণ্য বয়কটের এই ডাকে সাড়া দিচ্ছে।
সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় সুপারমার্কেট আথায়াম ছাড়াও দানিউব, তামিমি এবং পান্ডা চেইন শপ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে, তাদের বর্তমান মজুত শেষ হওয়ার পর তারা তুরস্কে তৈরি কোনো পণ্য বিক্রি করবে না।
সরকারপন্থী সৌদি বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবীরা গণমাধ্যমে এই বয়কটের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে জনমত তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি আরব নিউজ পত্রিকায় সুপরিচিত সৌদি রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ড. হামদান আল-সেহরি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তুরস্কের মাথা গলানোর কারণেই এই বয়কট।’
তার ভাষ্য, ‘ইরানের মতো তুরস্কও এখন এই অঞ্চলকে হুমকি দিচ্ছে। সন্ত্রাসী মিলিশিয়াদের সমর্থন দিচ্ছে, মুসলিম ব্রাদারহুডকে উসকানি দিচ্ছে। এতে আরব দেশগুলোর নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে।‘
২০১১ সালে আরব বসন্তের প্রতি তুরস্কের অকুণ্ঠ সমর্থনের পর থেকে রিয়াদ-আঙ্কারার সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। এরপর ২০১৭ সালে সৌদি জোট কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তার বিরোধিতা করেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।
এ ছাড়া ২০১৮ সালে ইস্তান্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যেভাবে সৌদি রাজপরিবারকে দায়ী করেন, তাতে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
এ বয়কটের কারণে বিপাকে পড়েছে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, স্প্যানিশ ব্রান্ড ম্যাঙ্গো, যাদের পোশাকের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ তৈরি হয় তুরস্কে, তারা সৌদি আরবে বিক্রির জন্য বিভিন্ন দেশে পোশাক তৈরির বিকল্প রাস্তা খুঁজছে। সৌদি আরবে ম্যাঙ্গোর ৫০টির মতো দোকান রয়েছে।
তুরস্ক থেকে পণ্য আমদানিতে সৌদি কাস্টমস নানা ধরনের জটিলতা করে রেখেছে। ফলে ম্যাঙ্গো তুরস্কের সরবরাহকারীদের জানিয়ে দিয়েছে, অন্য দেশে পোশাক তৈরি ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।
তুরস্কের আটটি প্রধান ব্যবসায়ী সমিতি গত মাসে এক যৌথ বিবৃতিতে জানায়, তারা সৌদি আরবের ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক আচরণের তীব্র নিন্দা করেছে। এই বিরোধ না মিটলে দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে সৌদি আরবে এই বয়কটের বিষয়ে এখনও স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
তবে সরকারপন্থী তুর্কি সংবাদপত্র ইয়েনি সাফাকে এক উপ-সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে যে, এই বয়কট সৌদি আরবের জন্যই আত্মঘাতী হবে।
এতে বলা হয়, তুরস্কের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের তুলনায় সৌদি আরবে তাদের রপ্তানির পরিমাণ এতই কম যে তাতে তুর্কি অর্থনীতির তেমন কোনো ক্ষতি হবে না, বরং ৮০ শতাংশ আমদানি নির্ভর সৌদি আরব সস্তায় মানসম্পন্ন পণ্য থেকে বঞ্চিত হবে।
তবে সৌদি অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আমাল আব্দুল-আজিজ আল-হাজানির মতে, তুর্কি অর্থনীতি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও কিন্তু নেতিবাচক অনেক প্রভাব তুরস্ক এড়াতে পারবে না।
তার হিসাব মতে, সৌদিরা তুরস্কে স্থাবর সম্পত্তির সবচেয়ে বড় ক্রেতা। একশো’রও বেশি তুর্কি কোম্পানি সৌদি আরবে ব্যবসা করছে। এক লাখের মতো তুর্কি নাগরিক সৌদি আরবে কাজ করে।
তিনি আরও বলেন, তুরস্ক ২০২৩ সালের মধ্যে আড়াই হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সৌদি বিনিয়োগ টার্গেট করেছিল, আর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দুই হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
রাজনৈতিক সম্পর্ক চটে যাওয়ায় তুরস্কের এসব টার্গেট শুধু কাগজে থেকে যাবে, মনে করছেন সৌদি এই বিশ্লেষক।