বিশ্বজুড়ে কলেরা রোধে বাংলাদেশের ডা. ফেরদৌসীকে কৃতিত্ব দিলেন বিল গেটস
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ অক্টোবর ২০২০, ৩:০৮:১৮
করোনাভাইরাসের আগ্রাসন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলা মহামারিকে আড়াল করে দিয়েছে। দুইশ বছর ধরে পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়ানো সেই মহামারি হচ্ছে কলেরা। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকটে ভোগা এলাকাগুলোতে এটি মরণথাবা বসিয়েছিল। এই মহামারি কেড়ে নিয়েছে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ।
কলেরার বর্তমান প্রাদুর্ভাবটি শুরু হয় ১৯৬১ সালে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে আফ্রিকা এবং আমেরিকা অঞ্চল পর্যন্ত এটি ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি বছর ৪০ লাখের মতো মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয় আর মারা যায় এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি।
এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে নিরাপদ ভ্যাকসিন, যেটি আক্রান্ত রোগীকে মুখে খাওয়ানো হয়ে থাকে। ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে কলেরার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ ডা. ফেরদৌসী কাদরী।
২৫ বছর ধরে কলেরার বিরুদ্ধে লড়ছেন বাংলাদেশি এ চিকিৎসক। তার ভূয়সী প্রশংসা করতে কলেরা নিয়ে উপরের বর্ণনাটুকু দেন বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস।
মঙ্গলবার নিজের ব্লগ ‘গেটস নোটে’ কলেরা নিয়ন্ত্রণে ডা. ফেরদৌসীর অসাধারণ ভূমিকার কথা তুলে আনেন তিনি।
কলেরা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখার জন্য বৃহৎ পরিসরে চালানো ভ্যাকসিন কার্যক্রমের প্রশংসা করেন বিল গেটস। এ কার্যক্রমের ফলে ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে কলেরা সংক্রমণের হার ৬০ শতাংশ কমে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে ৩৬ শতাংশ।
মহামারিটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য পুরো বিশ্বে যে কয়েকজনের ভূমিকা অনস্বীকার্য, তার মধ্যে একজন হচ্ছেন ফেরদৌসী কাদরী। এই ইমিউনোলজিস্ট এবং সংক্রামক রোগ গবেষক পুরো জীবন ব্যয় করেছেন কলেরা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে। ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে পুরো জনগোষ্ঠীকে কলেরা থেকে রক্ষার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
১৯ শতকের শেষের দিকে যখন একাধিক কলেরা ভ্যাকসিন চলে আসলেও সেগুলো ছিল খুবই দামি, সহজলভ্যও ছিল না।ধনী দেশগুলোর নাগরিকেরা গরিব দেশগুলোতে ভ্রমণ করার সময় এটি নিয়ে যেতেন। কিন্তু গরিব দেশের মানুষের জন্য সেই টিকা ছিল অধরাই।
বিল গেটস বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আলো দেখান ফেরদৌসী কাদরী এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এ তার টিম। আরও কম মূল্যে এবং সহজলভ্য একটি ভ্যাকসিনের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন তিনি। শানকোল নামে পরিচিত ভ্যাকসিনটি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ফাউন্ডেশনের (মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন) অংশীদারত্বে পরিচালিত হয় গবেষণাটি। যেটি দেখিয়েছে, সস্তা এই ভ্যাকসিনটি দরিদ্র ও শহুরে পরিবেশে কলেরার বিস্তার রোধে কার্যকর সরঞ্জাম হতে পারে। এ মহামারিটি থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি সুরক্ষা দেবে।’
ডা. ফেরদৌসীর এ গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে কলেরার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন ট্রায়ালটি পরিচালিত হয়েছে। বিল গেটস বলছেন, ‘কলেরার চ্যালেঞ্জ বিশ্ব কীভাবে মোকাবিলা করতে সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল তার গবেষণা।’
এ ব্যাপারে ডা. ফেরদৌসী বলছেন, ‘মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হবে না-যদি নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, শিক্ষা এবং ভালো বাসস্থান সুবিধা পায়। যতক্ষণ না এসব অর্জন হচ্ছে, আপনাকে আপনার দুর্দশা রোধ করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ করতে হবে। এবং ভ্যাকসিনই হতে পারে একমাত্র সমাধান।’
এ কলেরা যোদ্ধা এখন কাজ করছেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নমূলক অভিযান থেকে বাঁচতে দেশটির মুসলিম সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠীটির সাড়ে সাত লাখ মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বড় ধরনের কলেরা ঝুঁকিতে আছে। ডা. কাদরী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কলেরা ভ্যাকসিন কার্যক্রমে যুক্ত আছেন। তার নেতৃত্বে এই কার্যক্রম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কলেরা প্রাদুর্ভাব রোধে সহায়তা করেছে।
কলেরা প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে বিশ্বজুড়ে কাজ করছে একটি টাস্ক ফোর্স। ৫০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান এ টাস্ক ফোর্সের সঙ্গে যুক্ত আছে। এই টাস্ক ফোর্সের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে কলেরায় মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা এবং ২০টি দেশ থেকে এ মহামারিকে নির্মূল করা।
বিল গেটস বলেন, ‘ডা. কাদরীর অগ্রণী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ, কলেরা মোকাবিলায় বিশ্ব তার লক্ষ্য অর্জন করতে যাচ্ছে। কোনও একদিন কলেরা এমন একটি রোগ হবে যাকে সত্যই ভুলে যাবে মানুষ।’