ডালডায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাত্রায় ‘ট্রান্সফ্যাট’
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:৫৬:৪৩
ডালডায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ‘ট্রান্সফ্যাট’-এর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকর এই উপাদান হৃদ্রোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকির অন্যতম প্রধান কারণ।
ডালডার প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় ২ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট থাকার কথা থাকলেও সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট মিলেছে।
শনিবার বেলা ১২টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে ডালডায় ক্ষতিকর উপাদান নিয়ে অ্যাসেসমেন্ট অব ট্রান্সফ্যাট ইন পিএইচও ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।
২০১৯ সালে গবেষণাটি করেছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। গবেষণায় সহায়তা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট।
গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি হিসেবে পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও) ব্যবহার করা হয়। বাসাবাড়িতে এর ব্যবহার কম হলেও ভাজা-পোড়া স্ন্যাকস, বেকারিপণ্য ও বাণিজ্যিক উৎপাদনে তৈরীকৃত খাদ্যপণ্যে এটি বহুল ব্যবহৃত হয়। এই পিএইচওতে ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিএফএ) পাওয়া গিয়েছে। এই টিএফএ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল (পাম, সয়াবিন) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনশন করা হলে তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো অর্ধকঠিন মারজারিন বা কঠিন ডালডা বা বনস্পতি ঘি উৎপন্ন হয়, যা বাজারে ডালডা নামে পরিচিত। এই উচ্চমাত্রার ট্রান্সফ্যাটযুক্ত ডালডা গ্রহণের সঙ্গে উচ্চহারে হৃদ্রোগ, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) ও স্মৃতিহানি রোগ ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত।
গবেষণার জন্য ঢাকায় খুচরা বিক্রেতাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন বেকারি ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত পিএইচওর চারটি শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড পিওর, পুষ্টি, সেনা ও তীরের ডালডার ২৪টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এরপর পর্তুগালের লিসবনে ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউটের ফুড কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে এসেছে, ২৪টি নমুনার মধ্যে ২২টিতে (৯২%) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি ১০০ গ্রামে সর্বোচ্চ ২ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের সুপারিশ করেছে। নমুনাগুলোয় প্রতি ১০০ গ্রামে সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ৬৯ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
গবেষণার ফলাফলে আরও এসেছে, একই ব্র্যান্ডের নমুনায় ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণে তারতম্যের উপস্থিতি। যেমন, একটি ব্র্যান্ডের ডালডার নমুনায় শূন্য দশমিক ৬৯ গ্রাম থেকে ১৪ দশমিক ৫ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গিয়েছে। এসব শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাদ্যপণ্য জনস্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী। এর আগে সংবাদ সম্মেলনে প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) ট্রান্সফ্যাক্ট প্রকল্পের দলনেতা মো. হাসান শাহরিয়ার বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে সীমা বেঁধে দিয়েছে প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রাম ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ করা ও ট্রান্সফ্যাটের উৎস নিষিদ্ধ করা—এই দুইটি করণীয়। কারণ, ২০২৩ সালের মধ্যে পৃথিবীতে মানুষের খাদ্যশৃঙ্খল থেকে ট্রান্সফ্যাট সরানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই লক্ষ্যে বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে ইতিমধ্যেই ট্রান্সফ্যাটের সীমা নির্ধারণ করেছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আহম্মাদ একরামুল্লাহ বলেন, বাজারে তৈরীকৃত খাদ্যপণ্যের গায়ে অবশ্যই ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা উল্লেখ করে লেবেল দেওয়া উচিত।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক আবদুল মালিক সংবাদ সম্মেলনে অনলাইনের মাধ্যমে যুক্ত হন। তিনি বলেন, খাদ্যপণ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা জরুরি। ট্রান্সফ্যাট খাওয়া কমিয়ে পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন গবেষণা কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানকারী গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের বাংলাদেশের প্রধান মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, গবেষণাটির উপদেষ্টা আবু আহাম্মদ শামীম প্রমুখ।